কর্মচারী সমিতির ৩৩২ কোটি টাকা লোপাটেও সায় তাকসিমের

শাহজাহান মোল্লা
১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কর্মচারী সমিতির ৩৩২ কোটি টাকা লোপাটেও সায় তাকসিমের

হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই পাল্টে গেছে ঢাকা ওয়াসার চিত্রপট। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় টানা ১৫ বছর এমডি পদে থেকে ঢাকা ওয়াসাকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। ঢাকাবাসীর পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হলেও বড় বড় প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় থাকতে বিভিন্ন সময় রিপোর্ট হলেও ‘অদৃশ্য আশীর্বাদে’ থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। শীর্ষপদ দীর্ঘসময় আঁকড়ে ধরে রেখে ঢাকা ওয়াসার ওপর বিদেশি ঋণের বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন তাকসিম এ খান। শেষ সময়েও একাধিক প্রকল্প নিয়ে বিদেশি সংস্থার সঙ্গে চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিলেন তিনি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রথমে গা ঢাকা দিয়েছিলেন বিতর্কিত এই প্রকৌশলী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর ফের নিজ পদে আসীন হয়ে প্রভাব খাটাতে তৎপর হয়ে ওঠেছিলেন, এমডি পদে থেকে যেতে চেয়েছিলেন মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত। কিন্তু সেটা আর হয়নি। অবস্থা বেগতিক দেখে গত ১৪ আগস্ট পদত্যাগ করেন ওয়াসার ইতিহাসে সর্বাধিক ক্ষমতাধর এই এমডি।

তাকসিম ওয়াসার এমডি থাকাকালীন তার আনুকূল্য পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও হয়ে ওঠেছিলেন বেপরোয়া। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এমন ৪৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে যারা এখনো বহাল রয়েছেন। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্তে তাদের এহেন দুর্নীতির প্রমাণ তুলে ধরা হলেও অদৃশ্য কারণে চুপ ছিলেন সদ্য সাবেক এমডি তাকসিম এ খান। এই ৩৩২ কোটি টাকার মধ্যে কে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন, তা-ও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে সংস্থার নিজস্ব কোনো তদন্ত হয়নি বা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উপরন্তু তাদের নাম ছিল পদোন্নতির আলোচনায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এমডি এ কে এম সহিদ উদ্দীন আমাদের সময়কে বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। তবে পত্রিকায় খবর দেখেছি। যেহেতু প্রশাসনিক বিষয়, তাই এটা এমডি সাহেব জানতেন। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, আমি রবিবার অফিস খোলার পর বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইব। তিনি বলেন, শুধু এটা নয়। যত অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সব খতিয়ে দেখা হবে। কোথাও দুর্নীতি অনিয়মের প্রমাণ পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের আয়ের উৎস গ্রাহকের বিল থেকে পাওয়া কমিশন। ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য ১৯৯৬ সাল থেকে পানির

বিল আদায়ের কাজটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হয়। ‘প্রোগ্রাম ফর পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট (পিপিআই)’ কার্যক্রমের আওতায় ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই সমিতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা ওয়াসার সাতটি রাজস্ব অঞ্চলে গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায়ের কাজ করে। এর বিপরীতে তারা মোট বিলের ১০ শতাংশ কমিশন হিসেবে পেয়েছে।

ব্যয় নির্বাহের পর ঢাকা ওয়াসা থেকে কমিশন বাবদ পাওয়া উদ্বৃত্তের সুবিধাভোগী হওয়ার কথা সমিতির সাধারণ সদস্যদের। কিন্তু তাদের বঞ্চিত করে ব্যবস্থাপনা কমিটির কেউ কেউ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এ সকল অভিযোগ তদন্তে ২০২৩ সালের ৬ জুলাই মাসে সমবায় অধিদপ্তর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মুহাম্মদ মিজানুর রহমানকে। তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে মুহাম্মদ মিজানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, তদন্তে অর্থ আত্মসাতের সত্যতা পাওয়া যায়। আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন জেলা অফিসকে দিয়েছি। জেলা অফিস পরবর্তীতে কি করেছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলাও হয়েছে জেনেছি। এখন কি অবস্থায় রয়েছে তা জানি না।

অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শাহাব উদ্দিন সরকার আমাদের সময়কে বলেন, দুর্নীতিবাজ এমডি তাকসিম এ খান অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং প্রমোশন দিয়েছে। যারা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতে জড়িত, তাদের অনেকেরই প্রমোশন দিয়ে গেছেন এই সাবেক এমডি। আমাদের একটাই দাবিÑ আত্মসাৎকৃত টাকা ফেরত দিতে হবে। এ বিষয়ে দুদকে একটি মামলা চলমান রয়েছে। আশা করি, আমরা ন্যায়বিচার পাব।

কি ছিল তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যবস্থাপনা কমিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে স্পষ্ট যে, অর্থ লোপাট করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমিতির নামে। অথচ তা পরিচালনা করেন পিপিআই (সমিতির অধীনে নেওয়া একটি প্রকল্প) পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান। সমিতির নামে ব্যাংক হিসাব খুলে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তা পরিচালনা করা সমবায় সমিতি আইনের পরিপন্থি।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার সিবিএর সাবেক সভাপতি প্রয়াত হাফিজ উদ্দিন একাই আত্মসাৎ করেছেন ৪৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া পাম্পচালক শামসুজ্জামান ১৩ কোটি ৩৫ লাখ, রাজস্ব পরিদর্শক ছিদ্দিকুর রহমান ১২ কোটি ৯৭ লাখ, আশরাফুল আলম ১১ কোটি ৪৯ লাখ, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আরমান ভূঁইয়া ১১ কোটি ৪৯ লাখ, সহকারী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ৯ কোটি ৫৬ লাখ, ওয়াসা সিবিএর সাধারণ সম্পাদক আসকার ইবনে সায়েক ৬ কোটি ৬৮ লাখ, রাজস্ব পরিদর্শক জাকির হোসেন ৬ কোটি ৬৭ লাখ, সফিকুল ইসলাম ৬ কোটি ৬৭ লাখ এবং গাড়িচালক সংঘের সভাপতি বাবুল আলী ৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অভিযুক্ত অন্য ব্যক্তিরা আত্মসাৎ করেছেন ৪ লাখ থেকে ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত।

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্তদের কয়েকজন এর মধ্যে মারা গেছেন। কয়েকজন অবসরে চলে গেছেন। অন্যরা চাকরিরত।

এদিকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর সমিতির তিনজনের বিরুদ্ধে গত ১০ মে মামলা করেছে দুদক। মামলার আসামিরা হলেন সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মিঞা মো. মিজানুর রহমান, হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া ও কম্পিউটার অপারেটর নাইমুল হাসান।

দুদকের করা মামলার আসামি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ৩৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। সমবায় অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, দুদকের মামলার অপর আসামি হাবিব উল্লাহ ভূঁইয়া ৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা ও নাইমুল হাসান ১ কোটি ৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।