দুর্নীতির ট্যাপ খুলে দেন তাকসিম

শাহজাহান মোল্লা
১২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
দুর্নীতির ট্যাপ খুলে দেন তাকসিম

পাঁচ বছর পর-পর সরকারের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের মেয়াদ শেষ হয় না, দফায় দফায় বাড়তেই থাকে। তার বিরুদ্ধে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ব্যর্থতার অভিযোগ তো রয়েছেই; নানান অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। ওয়াসার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম-দুর্নীতির ট্যাপ খুলে দেওয়া তাকসিম টানা ১৫ বছর ধরে বহাল আছেন স্বীয় পদে।

এমডি হিসেবে তাকসিম প্রথমবার দায়িত্ব গ্রহণের পর ‘ঘুরে দাঁড়াও’ কর্মসূচি দিয়ে দৃষ্টি কাড়েন। বাস্তবে কিন্তু মোটেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ওয়াসা। বরং ১৫ বছরে মেগা প্রজেক্টের নামে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছেন তিনি। ওয়াসার সাবেক এক চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, এই ঋণ পরিশোধ করা ওয়াসার পক্ষে অসম্ভব। কারণ ওয়াসার সব মধু এমডি তাকসিমের পেটে চলে গেছে। এদিকে ওয়াসার সেবার মান না বাড়লেও তাকসিম এ খানের বেতনভাতা বেড়েছে কয়েক দফা। ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে এখন ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতন ও আনুষঙ্গিক সুবিধা নিচ্ছেন তিনি। করোনাকালীন ৪ মাস (২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৪ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রে বসে ভার্চুয়ালি অফিস করেছেন। এর আগেও একাধিকবার বিদেশে বসে অফিস করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তার ১৪টি বাড়ি রয়েছে, এমন সংবাদও এসেছে গণমাধ্যমে। যদিও তিনি এই তথ্যকে অসত্য বলে দাবি করেছেন। তাকে নিয়ে নানা সময় সমালোচনা হলেও তিনি পাত্তা দেননি। এমনকি আদালত অবমাননার রুল জারি হলেও দমানো যায়নি তাকে।

শেখ হাসিনার সরকারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এতদিন তাকসিমের দাপটে কেউ মুখ খুলতে পারেননি। এখন প্রকাশ্যে আসছে তার সব অপকর্মের খবর। ওয়াসার অনেকেই বলেছেন, তিনি ছিলেন এখানকার রাজা। তার বিরুদ্ধে কথা বললেই চাকরি যেত, না হয় ওএসডি হতে হতো। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন তাকসিম এ খান। ৬ আগস্ট অফিস খুললেও তিনি যাননি। গতকাল রবিবারও তিনি অফিস করেননি। শাহজালাল বিমানবন্দরের বহির্গমন বিভাগের তথ্য বলছে- তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। হয়তো দেশেই কোথাও নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন। তবে ঠিক কোথায় রয়েছেন, তার কোনো তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।

প্রথমবার ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে তাকসিম ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, তাই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।’ এ জন্য তিনি সরকারপ্রধানকে বুঝিয়ে পানি শোধনাগার করতে বড় বড় প্রকল্প নেন। এরপর বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। যদিও পরে তার কথা আর কাজে মিল ছিল না। ২০০৯ সালে যখন দায়িত্ব নেন, তখন গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৪০০, বর্তমানে সেই গভীর নলকূপের সংখ্যা সাড়ে ৯০০। অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ পানির উৎস আরও বেড়েছে। তবে থেমে নেই তার বড় প্রকল্প।

ঢাকাবাসীকে পানির চাহিদা মেটানোর কথা বলে ২০১৯ সালের জুনে ‘পদ্মা-জশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প’ উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের সময় জানানো হয়, এই পানি শোধনাগার থেকে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই পরিমাণ পানি সরবরাহের মতো কোনো রেকর্ড দেখাতে পারেনি ওয়াসা। ওয়াসা কাগজ-কলমে ২৮ কোটি লিটার দেখালেও বাস্তবে পানি সরবরাহ হচ্ছে ২২ কোটি লিটার। ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে মাত্র ২২ কোটি লিটার পানি পাওয়া যাচ্ছে।

একইভাবে রাজধানীর আফতাবনগরে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকা শহরের পয়ঃবর্জ্য পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিয়ে সেখানে শোধন করে বালু নদীতে ফেলা হবে। ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই দাশেরকান্দি পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার প্রকল্পের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। ৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকার এই প্রকল্পও ড্রেনেজ লাইন নির্মাণের কারণে সুফল দিতে পারছে না। ঢাকা শহরের পয়ঃবর্জ্যরে কথা বলা হলেও বাস্তবে নেওয়া হচ্ছে ড্রেনেজের বর্জ্য। এটিও তাকসিমের শুভঙ্করের ফাঁকি।

শুধু দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার নয়, ঢাকা ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীকে পাঁচটি এলাকায় ভাগ করে পাগলা, দাশেরকান্দি, উত্তরা, রায়েরবাজার ও মিরপুরে মোট ৫টি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (পয়ঃশোধনাগার) নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০৩০ সাল নাগাদ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী সব কটি পয়ঃশোধনাগার বাস্তবায়ন হলে নগরবাসীর শতভাগ উন্নত ও টেকসই পয়ঃসেবা নিশ্চিত হবে বলে জানিয়েছিলেন এমডি তাকসিম।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের একছত্র ক্ষমতার বিষয়ে সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা আমাদের সময়কে বলেন, উনি (এমডি) পানি নিয়ে যে সফলতার কথা বলেন, সেটি তার কৃতিত্ব না। আগে মারাত্মক লোডশেডিং থাকায় পাম্প চালানো যেত না। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পানির ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া পানির উৎপাদন খরচ নিয়েও মিথ্যাচার করেছেন এমডি তাকসিম। বোর্ডের কারও কথাই তিনি শুনতেন না। আমরা যতবার বাধা দিয়েছি, তিনি শুধু বলতেন- ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন’। সবসময় প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবহার করেছেন। তাকসিম যদি উন্নয়নই করেন, তাহলে ওয়াসার ঘাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা চাপিয়েছেন কেন? এ ঋণ পরিশোধ করা ওয়াসার পক্ষে অসম্ভব।