ব্যাংকগুলোয় অস্থিরতা, হামলা
দখল হওয়া ব্যাংকের মালিকানা পুনরুদ্ধার, পর্ষদ পুনর্গঠন, লুটপাটকারীদের পদত্যাগ, অর্থপাচারে সহায়তাকারীদের অপসারণ, অবৈধ নিয়োগ বাতিল, চাকরিতে পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে ব্যাংকে ব্যাংকে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। গতকালও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকে বিক্ষোভ হয়েছে। একপর্যায় ইসলামী ব্যাংকের দখল নিয়ে দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে গুলির ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হন। তবে অন্য দুই ব্যাংকে সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে আর্থিক দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও দখলদারদের বিতাড়িত করতে বিক্ষোভ করছেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, দখল আর ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে পুরো আর্থিক খাতে ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তাই এসব অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিতাড়িত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বিক্ষোভে উত্তাল ইসলামী ব্যাংক : সরকার পতনের পর থেকে অস্থিরতা চলছে ইসলামী ব্যাংকে। ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গতকাল রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ চলাকালে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালের আগে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং এর পরে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এই সংঘর্ষ চলাকালে গুলির ঘটনাও ঘটে। এতে অন্তত ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তারা হলেন- শফিউল্লাহ, আবদুল্লাহ আল মামুন, আবদুর রহমান ও বাকি বিল্লাহ। অন্য দুজনের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তারা ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ২০১৭ সালের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে সকালে পুরনো কর্মীরা ঘোষণা দেন। ওই বছরের পরে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ কর্মীই চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার, সে কারণে তারা পটিয়ার কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে পরিচিত। পুরনো কর্মীদের ঘোষণার পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পটিয়ার কর্মীরা আশপাশে জড়ো হয়ে ব্যাংকের দিকে রওনা দেন। পুরনো কর্মীরা তাদের বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলি ছোড়া হলে কয়েকজন আহত হন। পুরনো কর্মীরা গুলি ছোড়ার জন্য পটিয়ার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়ী করেন।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের এসইভিপি শওকত আলী বলেন, আমরা জানতে পারি এস আলমের বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, যারা ব্যাংকটিকে লুটপাট করেছে, তারা তাদের লোকদের ব্যাংকে বসাবে। এ তথ্য পেয়ে আমরা ব্যাংকের সামনে অবস্থান নিই, যাতে তারা ব্যাংকে ঢুকতে না পারে। একপর্যায়ে এস আলমের লোকজন সিটি সেন্টারে অবস্থান নেয়। পরে তারা মিছিল নিয়ে প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চায়। তখন কর্মকর্তারা তাদের প্রতিহত করতে গেলে এস আলমের লোকজন তাদের উদ্দেশে গুলি চালায়। এতে ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন। তিনি আরও জানান, ‘বৈষম্যবিরোধী ব্যাংকাররা’ সে সময় প্রতিরোধ করলে এস আলমের পক্ষের লোকজন পালিয়ে যায়।
এদিকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিরুল মওলা গতকাল অফিসে যাননি। পুরনো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, মুনিরুল মওলা ব্যাংকে ঢুকতে চাইলে তাকেও বাধা দেওয়া হবে। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ‘লুটেরাদের’ বের করে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি তারা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিরুল মওলা, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাউসার আলী, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিনসহ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন।
সালমান এফ রহমানের পদত্যাগের দাবিতে আইএফআইসি ব্যাংকে বিক্ষোভ : বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলেসহ বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিনিধিত্বকারী সব পরিচালকের পদত্যাগ দাবি করে গতকাল বিক্ষোভ করেন ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহ এ সরোয়ারের সময়ে ‘অন্যায়ভাবে’ যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের পুনর্বহালের দাবি তোলা হয়েছে। রাজধানীর পুরানা পল্টনে অবস্থিত ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গতকাল সকাল ১০টায় দুই শতাধিক লোক ‘আইএফআইসি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত সকল কর্মকর্তাবৃন্দ’ লেখা ব্যানারে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।
সালমান এফ রহমান শেখ হাসিনা সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাকে কোথাও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তার ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। বিক্ষোভকারীরা বলেন, সালমান এফ রহমান হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন সাবেক এমডি শাহ আলম সরোয়ার, যিনি বর্তমানে ব্যাংকটির উপদেষ্টা। শাহ আলম সরোয়ার ‘মানসিক চাপ সৃষ্টি করে’ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে- যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাদের অবিলম্বে পুনর্বহাল করা। তবে যারা ইতোমধ্যে চাকরির বয়স অতিক্রম করেছেন, তাদের পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধিসহ পাওনা পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল না করা, ঋণের সুদ মওকুফ না করা, দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যকার ভয়ের সংস্কৃতি দূর করা, শাহ আলম সরোয়ার ও তার সহযোগীদের বিচার করা, পদোন্নতি না পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি দেওয়া ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করা হয়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এস আলমমুক্ত করতে শেয়ারধারীদের মানববন্ধন : বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে (এসআইবিএল) এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন করেছেন ব্যাংকটির কিছু শেয়ারধারী। তারা ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে তারা বলেন, ২০১৭ সালে শরিয়াভিত্তিক পরিচালিত এসআইবিএলের মালিকানা ওই সময়কার পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দখল করে নেয় এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের চরমভাবে হেনস্তা করে এক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের যোগসাজশে অবৈধভাবে রাতের আঁধারে ব্যাংকটির মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দাবি- দখলমুক্ত করে প্রকৃত মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের নিকট ব্যাংকটির মালিকানা হস্তান্তর করা হোক। তারা আরও অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। ফলে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতে পারছেন না। মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক, সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুর রহমান, আবুল বসর ভূঁইয়াসহ সাধারণ ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারীরা।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে (ইউসিবি) সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে বিক্ষোভ করেন ব্যাংকের দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা এই দাবি জানান। এ সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এর আগে গত বুধবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকেও বিক্ষোভ হয়। চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়াসহ ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম এবং দেশ থেকে অর্থপাচারে সহায়তার দায়ে হাসিনা সরকারের চুক্তিভিত্তিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ দাবি করে ওই বিক্ষোভ করেন একদল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই দিন রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকেও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।