রাজনৈতিক সমাধানের বিকল্প নেই
আমাদের সময়কে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা
অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা আর শঙ্কার মধ্যে দেশের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে অর্থনীতিতে একটি অপ্রত্যাশিত ক্ষত তৈরি হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে এমন অচলাবস্থা তৈরি হবে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদরা কেউ ভাবতে পারেননি। বিদ্যমান পরিস্থিতির সমাধান না হলে দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে খারাপ বার্তা চলে গেছে। এ অবস্থায় কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। সবকিছু মিলে আগামীতে অর্থনীতিতে দুর্দিন আসছে। অচলাবস্থা এখনই সমাধান করতে হবে। দেশে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কঠিন। এ জন্য দেশে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। তবে পরিবর্তনটি শান্তিপূর্ণভাবে হতে হবে। দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন।
পলিসি রিসার্র্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর দেশে এত বড় ক্ষতি হয়নি। অর্থনীতিতে বিশাল ক্ষতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর এত বড় জানমালের ক্ষতি হয়নি। এ জন্য দেশে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। তিনি বলেন, আলোচনার পথ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তবে পরিবর্তন এমনভাবে হতে হবে, যাতে করে রক্তক্ষরণ না হয়। রক্তের ঝরনা আর দেখতে চাই না। কোনো পক্ষের লোক মারা যাক তা চাই না। তবে পরিবর্তন হতে হবে। পরিবর্তন কোটা সংস্কার বা ৯ দফা নিয়ে নয়; দুর্নীতি, অসংস্কৃতি, রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে পরিবর্তন হতে হবে। এটি যাতে চিরতরে বন্ধ হয়, সেভাবে পরিবর্তন হতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, তবে এক্ষেত্রে কোনো দল যাতে সুবিধা না পায়, সেদিকে খেয়াল করতে হবে। দেশের এমন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে (প্রধান) দুই দলই (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) দায়ী। তিনি বলেন, শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে হবে। দ্রুত অব্যাহতির ব্যবস্থা হলে তা হবে সবার জন্য ভালো। আশা করি শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন হবে। এক্ষেত্রে ঠাণ্ডা মাথার লোকদের ঠাণ্ডাভাবে চিন্তা করতে হবে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কঠিন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শরীরে রক্তক্ষরণের মতো। রক্তক্ষরণের সময় অন্য চিকিৎসা করা যায় না। প্রথমে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হয়। ফলে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে এখন রাজনৈতিক সমাধানের বিকল্প কিছু নেই। ইতোমধ্যে সুশীল সমাজের অনেকেই মাঠে নেমেছেন।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়েছে। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন অর্থনীতির সব চাকাই বন্ধ ছিল। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এটি রাজনৈতিক সমস্যা, আর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতির কারণে আগামী মাসগুলোতে ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। পাশাপাশি রপ্তানি আদেশ হারানোর ঝুঁঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তাই অনেক কোম্পানি কর্মীদের সময়মতো বেতন দিতে হিমশিম খাবে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ঘটে যাওয়া সহিংসতার প্রভাব রপ্তানিসহ সামগ্রিকভাবে দেশের প্রবৃদ্ধিতে অনুভূত হয়েছে। অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়ে গেল। চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, তা অর্জন কঠিন হয়ে গেল। এমনকি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন নাও হতে পারে। সবাই এই ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক খাতের বড় ধরনের ক্ষতি হলো। শুনেছি, অনেক বিদেশি ক্রেতা চলে গেছেন। অনেকে তাদের ক্রয়াদেশ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন। অচলাবস্থার কারণে অনেক কারখানা মালিকের পক্ষে সময়মতো পোশাক ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এসব কারণে বিদেশি পোশাক ক্রেতাদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
আবু আহমেদ বলেন, কৃষি ছাড়া অর্থনীতির সব খাত নেতিবাচক ছিল। এরপর টানা অচলাবস্থা দেশের অর্থনীতির বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। ইতোমধ্যে আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, লেনদেন, পণ্যের সরবরাহ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সেবা খাতে স্বল্পমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব ভয়াবহ। সবকিছু মিলে আগামীতে অর্থনীতিতে দুর্দিন আসছে। অচলাবস্থার এখনই সমাধান না হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের জীবনধারণই মুশকিল হবে। তিনি বলেন, সামনে দেশের অর্থনীতির জন্য আরও বড় সংকট আসছে। এ কারণে রাজনৈতিকভাবে সংকট সমাধান করতে হবে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন