ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা-বাবা

রায়হান উদ্দিন, চট্টগ্রাম
২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ মা-বাবা

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল শাহজালালে থাকতেন তিনি। হলটি শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠন সিক্সটি নাইন উপ-গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। হৃদয় তরুয়া গ্রুপটির কর্মী ছিলেন।

চবির ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা রাজমিস্ত্রি বাবা রতন চন্দ্র তরুয়ার ছোট সন্তান। মা অর্চনা রানী অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। নিজের কঠোর পরিশ্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েছিলেন হৃদয়।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে সংসারের হাল ধরতে চেয়েছিলেন হৃদয়। বাবাকে ফোন করলেই বলতেন, বাবা আর কয়েকটা বছর। তারপর আর কষ্ট করতে হবে না।

হৃদয় তরুয়ার বড় বোন মিতু রানী বলেন, ভাইটা খুবই মেধাবী ছিল। হৃদয়ও জানত, তার ওপর কত বড় দায়িত্ব। আমার ভাই তো কোনো অস্ত্র তুলে নেয়নি। কাউকে আঘাতও করেনি। হয়তো কোটা আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। তাকে কেন গুলি করতে হবে? আমরা এর বিচার চাই।

গতকাল সিক্সটি নাইনের নেতা ও চবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক পার্থ প্রতীম বড়ুয়া আমাদের সময়কে বলেন, হৃদয় তরুয়া ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। আমাদের গ্রুপের সব প্রোগ্রামে হৃদয় উপস্থিত থাকতেন।

গত ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন চবি শিক্ষার্থী হৃদয় তরুয়া। চার দিন আইসিইউতে থাকার পর গত মঙ্গলবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান তিনি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলিতে হৃদয়ের ফুসফুস ফুটো হয়ে গিয়েছিল।

ছেলের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে বিলাপ করছেন আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন অর্চনা রানী; পাগলপ্রায় বাবা। পরিবারের জীবনযুদ্ধের কথা তুলে ধরে মিতু বলেন, মা বাসাবাড়িতে কাজ করে জমানো টাকা হৃদয়ের জন্য পাঠাতেন। ও চাকরি করবে, দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাবে, সেই আশায় ছিলাম সবাই। কিন্তু একটি বুলেট প্রাণ কেড়ে নিল।

চবি শাখা ছাত্রলীগের নেতারা জানান, প্রথমে কোটা আন্দোলনটা ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের। সেখানে অনেক ছাত্রলীগের কর্মীরা যোগ দেন। পরে এ আন্দোলনে যোগ দেয় সরকারবিরোধীরা। এর মধ্যে গত ১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে আন্দোলনে মারা যান ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম ও শিবিরকর্মী ফয়সাল আহমেদ শান্ত। তখনই জানা যায় আন্দোলনের কন্ট্রোল কার হাতে। বিষয়টি বুঝতে পেরে তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কোটা আন্দোলন থেকে সরে আসেন।

পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বলেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হৃদয় তরুয়াকে জামায়াত-বিএনপির নেতারাই গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও হৃদয়ের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম নিঝুম বলেন, ১৮ জুলাই বহদ্দারহাট মোড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান করি। সঙ্গে হৃদয় তরুয়াসহ আমার কয়েকজন বন্ধু ছিলাম। বিকালের দিকে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের গোলাগুলি শুরু হয়। আমরা দৌড়ে সরে যাওয়ার একপর্যায়ে হৃদয় গুলিবিদ্ধ হন। তার বুকের একপাশ দিয়ে গুলি লেগে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। হৃদয়কে প্রথমে পার্কভিউ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে ৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গত মঙ্গলবার ভোরে হৃদয় মারা যান। আমরা পুলিশ থেকে দুইশ গজ দূরে ছিলাম। গুলিটি পুলিশের হবে না। অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের হবে।

জানা গেছে, ঘটনার দিন প্রথমে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর যোগ দেয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা। সংঘর্ষ চলাকালে পিস্তল নিয়ে চার ব্যক্তিকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। অস্ত্র উঁচিয়ে প্রকাশ্যে গুলির দৃশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, অস্ত্রধারীরা সবাই যুবলীগের নেতাকর্মী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এদের বুলেটে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন হৃদয়। ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও সেই অস্ত্রধারীরা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।

গতকাল এ বিষয়ে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, আন্দোলনে হতাহতের ঘটনাগুলোয় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কেউ জড়িত থাকলে আইনের আওতায় আনা হবে।