আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা, শঙ্কিত মা-বাবা

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা, শঙ্কিত মা-বাবা

‘আমার সন্তান খুবই শান্ত। রক্ত দেখলে অজ্ঞান হয়ে যায়। ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়েছিল সহপাঠী-বন্ধুদের সঙ্গে। ওকে বাধা দিতে পারিনি। কিন্তু সারাক্ষণ কলজে হিম হয়ে আসছিল। একটা মাত্র ছেলে আমার। ও বেঁচে ফিরে এলেও এখন সারাক্ষণ আতঙ্কে কাটে। যেভাবে ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্তের কথা বলে গণহারে গ্রেপ্তারের কথা শুনছি, কখন যে সন্তানকে আমার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে যায়! বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডিবি পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার পর এ আতঙ্ক আরও বেড়েছে।’- ভীষণ উদ্বেগের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের একজন চাকরিজীবী। সন্তানকে নিয়ে যারপরনাই শঙ্কিত।

শুধু তিনিই নন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে এখন অধিকাংশ মা-বাবাই উৎকণ্ঠায় আছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোর অধিকাংশ মেস-বাসা ফাঁকা হয়ে গেছে আতঙ্কে। অতিপ্রয়োজনেও সন্তানকে ঢাকায় পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা। এদিকে রাজধানীতে আটকদের খোঁজে থানাগুলোতে ও মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে স্বজনদের ভিড় বাড়ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতাকে কেন্দ্র করে দায়ের হওয়া ২২৯টি মামলায় ২ হাজার ৭৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এর মধ্যে গত শনিবার সকাল থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২২৮ জনকে। ঢাকার বাইরেও গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে ডিএমপির বিভিন্ন টিম।

তবে পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স) এনামুল হক সাগর গতকাল রাতে আমাদের সময়কে বলেন, অপরাধে যারা জড়িত নয়, তাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা নাশকতা ও সহিংসতায় অংশ নিয়েছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গ্রেপ্তার আতঙ্কে ঢাকার অধিকাংশ মেস ও ছাত্রাবাস ফাঁকা হয়ে গেছে। চাকরি কিংবা জরুরি প্রয়োজনে যারা ঢাকায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, তারাও আতঙ্কে রয়েছেন। বিশেষ করে রাত বাড়লেই ভয় বাড়ে। পুরান ঢাকার একটি মেসে থাকেন রাহাত (ছদ্মনাম)। গতকাল তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তারা ছয়তলা একটি ভবনে থাকেন। ভবনের অর্ধেক ফ্ল্যাটে ব্যাচেলররা থাকেন। বেশিরভাগই বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী। গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হওয়ার পরই সবাই ভয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। চাকরির জন্য বাধ্য হয়ে পুরো ফ্ল্যাটে তিনি একাই থেকে গেছেন। কিন্তু রাত বাড়লেই আতঙ্ক বাড়ে। কখন পুলিশ আসে, দরজায় ঠকঠক করে। অনেক চেষ্টায় ভোর রাতে ঘুম এলেও মাঝে-মধ্যেই অজানা আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় আতঙ্কে মেস ও ছাত্রাবাস ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়, কবি নজরুল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ঢাকার ফার্মগেট, মিরপুর, বাড্ডা ও যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় যেসব মেস-বাসা ছিল, সেগুলোর প্রায় পুরোটাই ফাঁকা হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিনই স্বজনদের খোঁজে আদালত, থানা ও ডিবি কার্যালয়ের সামনে ভিড় বাড়ছে। কয়েক দিন ধরে খোঁঁজ না পাওয়া মানুষের স্বজন কিংবা বাসা থেকে তুলে আনা ব্যক্তিদের হদিস পেতে এসব স্থানে ভিড় করছেন স্বজনরা। গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ের সামনে বিপুলসংখ্যক মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা যায় স্বজনদের খোঁজে। এখানে গতকাল অপেক্ষা করতে দেখা যায় ষাটোর্ধ্ব বছিরন বেগমকে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমার ছেলে সোহাগ হাওলাদার বরিশাল শহরের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকার মুদি দোকানদার।

গত ২৪ জুলাই রাজধানীর হেলথ এইড হাসপাতালে ভর্তি থাকা এক স্বজনকে দেখতে এসে নিখোঁজ হয়েছে সে। শুনেছি, হাসপাতাল থেকেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। একজন ফোন করে জানিয়েছে, সোহাগ ডিবিতে আছে। তাই ছেলের খোঁজ পেতে ডিবি কার্যালয়ের সামনে সারাদিন বসে আছি।

তার ছেলে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয় উল্লেখ করে বছিরন বেগম বলেন, আমার স্বামী মারা গেছেন। ছেলেই আমার দেখাশোনা করে। অশ্রুসিক্ত এই বৃদ্ধা বলেন, সোহাগের ১৭ মাসের একটি মেয়ে আছে। তার আয়ে আমার পরিবার চলে। আমার ছেলেটার সন্ধান না পেয়ে তার স্ত্রী পাগলপ্রায় হয়ে গেছে।

ডিবি কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষমাণ শারমিন আক্তার জানান, ঢাকার কেরানীগঞ্জের আটিবাজার থেকে শনিবার সন্ধ্যায় ডিবি পরিচয়ে তার স্বামী নাজিম উদ্দীনকে তুলে আনা হয়। তুলে আনার সময় সাদা পোশাকের ব্যক্তিরা নিজেদের কোনো পরিচয়পত্র দেখায়নি। পরিচয় জানতে চাইলে চরম দুর্ব্যবহার করে। শনিবার তুলে আনার পর রাত ১টা পর্যন্ত তিনি ডিবি কার্যালয়ের সামনে ছিলেন। আজও দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও স্বামীর কোনো তথ্য তিনি পাননি।

শারমিন আক্তার বলেন, আমার স্বামী নির্দোষ। তিনি নিউরো ও উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। ওষুধ না খেতে পারলে যে কোনো সময় তার একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। আমার তিন বছরের মেয়েটির হার্টের সমস্যা। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। এখন স্বামীর এ অবস্থায় আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে এনেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। নিরাপত্তার স্বার্থে ডিবি হেফাজতে রাখার দাবি করছে সংস্থাটি। গতকাল বিকালে মিন্টো রোডে ছেলের খোঁজ নিতে এসেছিলেন নাহিদের মা মমতাজ বেগম। সঙ্গে ছিলেন নাহিদের ফুফু, খালা ও তার স্ত্রী। নাহিদের মায়ের অভিযোগ, সন্তানের সন্ধানে ডিবি কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা। তবে ডিবি কার্যালয়ে তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি দারুণ শঙ্কায় আছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জরুরি প্রয়োজনেও তরুণ ও শিক্ষার্থীদের ঢাকায় আসতে দিতে ভয় পাচ্ছেন মা-বাবা ও স্বজনরা। ঢাকায় মেস বাসায় থেকে ছোটখাটো চাকরি করেন কিংবা টিউশনি করে জীবন নির্বাহ করেন এমন মানুষজনও ঢাকায় ফিরতে ভয় পাচ্ছেন। বেশি বিপাকে পড়েছেন ঢাকার বিভিন্ন কলেজ-মাদ্রাসায় উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তিতে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশের চলমান পরিস্থিতিতে স্থগিত হওয়া ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম গতকাল রবিবার থেকে আবার শুরু হয়ে আগামী ১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। তবে মফস্বল থেকে ঢাকায় কলেজ-মাদ্রাসাগুলো অধ্যয়নের সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে রাজধানীতে আসতে ভয় পাচ্ছে। শরীয়তপুরের এক অভিভাবক জানান, তার ছেলে ঢাকার ডেমরার একটি মাদ্রাসায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ভয়ে ঢাকায় আসতে দিচ্ছেন না। ছেলের শিক্ষা-দীক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

ডিএমপির ২২৯ মামলায় ২৭৩৬ গ্রেপ্তার : সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানায় ২২৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ হাজার ৭৩৬ জনকে। গত শনিবার সকাল থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২২৮ জনকে। আসামিদের গ্রেপ্তারে ঢাকার বাইরেও অভিযান চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশ হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অভিযান চালাচ্ছে ডিএমপির ডিবি কর্মকর্তারা। গতকাল ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, শনিবার দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে সহিংসতা ও নাশকতার মামলার দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। আসামিদের ধরতে ঢাকাসহ সারাদেশেই অভিযান চলছে।