রোগ নির্ণয় ফিতে স্বেচ্ছাচারিতা

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার

আজাদুল আদনান
১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
রোগ নির্ণয় ফিতে স্বেচ্ছাচারিতা

রোগ নির্ণয়ে দেশের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ইচ্ছেমতো ফি নির্ধারণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ফি নির্ধারণে নীতিমালা না থাকায় একই রিএজেন্ট (পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণ) ব্যবহার করে একই টেস্টের ফি একেক প্রতিষ্ঠানে একেকরকম। আবার সম্প্রতি ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে অধিকাংশ টেস্টের দাম বাড়নো হয়েছে। শুধু তাই নয়, যেসব প্রতিষ্ঠানে আগে সেবায় মূল্যছাড়ের সুযোগ ছিল, সেটিও সীমিত করা হয়েছে। ফলে রোগ নির্ণয় করতে গিয়েই নিঃস্ব হতে হচ্ছে রোগীদের।

রোগ নির্ণয়ের খরচে এমন তুঘলকি ঠেকাতে এবং স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে ২০২০ সালে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পরীক্ষার ফি নির্ধারণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সবশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দুই দফায় সভা করেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সভায় শিগগিরই নীতিমালা প্রণয়নের কথা জানানো হয়। গঠন করা হয় কমিটিও। কিন্তু চার বছর পার হলেও সে উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তরিকতার অভাবে নীতিমালার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। নীতিমালা না থাকায় একই রিএজেন্ট এবং সব সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন আমাদের সময়কে বলেন, বিষয়টি তার নজরে এসেছে। এ নিয়ে কাজ চলছে। তিনি বলেন, বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় ইচ্ছেমাফিক রোগ নির্ণয়ের মূল্য নির্ধারণ গ্রহণযোগ্য নয়। সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে।

একই পরীক্ষার মূল্য পাঁচ প্রতিষ্ঠানে পাঁচরকম: রক্তে কোলেস্টরেল ও চর্বির পরিমাণ জানতে লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করতে হয়। রাজধানীর ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই পরীক্ষার ফি ৯০০ টাকা। একই মানের এএমজেড হাসপাতালে ১২০০, আইসিডিডিআরবিতে ১২৬০ টাকা, লাইফ কেয়ার মেডিক্যাল সেন্টারে ১৩০০ এবং ল্যাব এইডে ১৪৩০ টাকা। একইভাবে প্রেগনেন্সি আল্ট্রাসনোগ্রাফির মূল্য ইবনে সিনায় ১০৫০ টাকা, এএমজেড ও লাইফকেয়ারে ১৫০০, পপুলারে ২ হাজার এবং ল্যাব এইডে ৩৫২০ টাকা। একই মানের প্রতিষ্ঠান হলেও দামের পার্থক্য ২৪৭০ টাকা।

ব্রেনের সিটি স্ক্যান এমএমজেড, লাইফকেয়ার ও ইবনে সিনায় ৪ হাজার টাকা এবং পপুলার এবং ল্যাব এইডে ৫ হাজার টাকা। চেষ্টের এক্স-রে আইসিডিডিআরবিতে ৮০০, ল্যাব এইড ও লাইফকেয়ারে ৬০০ এবং এমএমজেড হাসপাতালে ৫০০ টাকা। নেক ও চেষ্টের এমআরআই এমএমজেডে ৮ হাজার টাকা এবং ল্যাব এইডে ১২ হাজার টাকা। অ্যান্টিবডি পরীক্ষা আইজিজি ও আইজিএমের দামের পার্থক্য ৮০০ টাকা। এন্ডোস্কোপিতেও চার প্রতিষ্ঠানে দামের পার্থক্য ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা। ইবনে সিনায় যেখানে ১৮০০ টাকা, সেখানে লাইফকেয়ারে ২৪০০, পপুলারে ৩৫০০ এবং আইসিডিডিআরবিতে ৪৫০০ টাকা। কোলনস্কোপি পরীক্ষা লাইফকেয়ার ও ইবনে সিনায় ৬ হাজার টাকা হলেও পপুলারে ৯৫০০ এবং ল্যাব এইডে ১২ হাজার। একই পরীক্ষা প্রথম সারির স্কয়ার, ইউনাইটেড ও এভারকেয়ারে ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা।

হৃদযন্ত্রের সমস্যায় এনটি-প্রোবিএনপি টেস্ট আইসিডিডিআরবিতে ৩ হাজার, ল্যাব এইডে ৩ হাজার ৭৩০ এবং লাইফ কেয়ারে ৪৫০০ টাকা। পিছিয়ে নেই বাড্ডা জেনারেল হাসপাতাল, ফরাজী হাসপাতালের মতো তৃতীয় সারির হাসপাতালগুলোও। একই মানের হলেও সেখানেও টেস্টের ফিতে তারতম্য রয়েছে।

যা বলছে প্রতিষ্ঠানগুলো : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ধানমন্ডির সহকারী মহাব্যবস্থাপক অচিন্ত কুমার নাগ বলেন, কাগজে সবার রিএজেন্ট কাছাকাছি হলেও কিছুটা পার্থক্যে দামেও তফাত হয়। যেমন থ্রি-টেসলা এমআরআইতে কেউ হয়তো পার্মানেন্ট ম্যাগনেটে করছে। তারপরও দাম অনেক বেশি রাখছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইবনে সিনার এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, আমরা এভারকেয়ার, মেডিনোভা, ইউনাইটেড, ল্যাব এইড, পপুলারের পরীক্ষাগুলোর মূল্য সংগ্রহ করি। সবগুলো পর্যালোচনা করেই গড় দাম নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ ছাড় দিয়েও যথেষ্ট মুনাফা আসে। যে পরীক্ষা রোগী ৬০০ টাকায় করেন, একই টেস্ট তৃতীয় সারির প্রতিষ্ঠানে করালে ৬০ শতাংশ ছাড় পায়। এরপরও তাদের ৩০ শতাংশ মুনাফা আসে। সে হিসেবে প্রতিটি পরীক্ষায় কিছু প্রতিষ্ঠানের মুনাফা ৫০ শতাংশের বেশি থাকে।

তৃতীয় সারির বাড্ডা জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপক অনিবাস মৃধা অভি বলেন, দেশে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় তার সিংহভাগ রিএজেন্ট আসে ভারত ও চীন থেকে। আমরা যে রিএজেন্ট ব্যবহার করি পপুলার ও এএমজেডও তাই করছে। কিন্তু দামের পার্থক্য অনেক।

চার বছরেও উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি: ২০২০ সালে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সবশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। গঠন করা হয় কমিটিও। ওই কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর (প্রশাসন) আমাদের সময়কে বলেন, হাসপাতালগুলোকে একটা ক্যাটাগরি ও টেস্টের দাম নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা সভা হয়েছে। যেসব পরীক্ষায় মূল্য অস্বাভাবিক রাখা হচ্ছে সেটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে একটি তালিকা করা হয়েছে। এটি সমন্বয় করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব রোগ নির্ণয়ে : ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে গত দুই বছরে দেশে কয়েক দফা বেড়েছে ওষুধের দাম। এর প্রভাব পড়েছে রোগ নির্ণয় খরচেও। শুধু তাই নয়, মূল্যছাড়ের বিষয়টিও সীমতি করা হয়েছে। পপুলারের সহকারী মহাব্যবস্থাপক অচিন্ত কুমার নাগ বলেন, ‘ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে পরীক্ষায় খরচ বেড়েছে। ফলে ফি বাড়াতে বাধ্য হয়েছি আমরা।’ ডলারের কারণে বর্তমানে ৩০ শতাংশ খরচ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ল্যাব এইডের জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদা দ্বীপ। তিনি বলেন, দু-একটি ছাড়া সব পরীক্ষারই দাম বেড়েছে। পাশাপাশি টেস্টে মূল্যছাড়ও ১৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে।

রোগ নির্ণয়েই নিঃস্ব রোগী : থাইরয়েডের রোগী চাঁদপুরের বাসিন্দা শাহিনুর বেগম (৩৫) আল্ট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি পরীক্ষা করতে বিএসএমএমইউতে গেলে পপুলারে করাতে বলেন চিকিৎসক। তিনি বলেন, অসুস্থ স্বামী কাজ করতে পারেন না। খরচ কমাতে সরকারি হাসপাতালে গেছেন। কিন্তু ডাক্তার এখানে (পপুলার) পাঠিয়েছেন। পরীক্ষা করাতে গিয়েই সপ্তাহের খাওয়ার খরচের টাকা শেষ। আরেক চিকিৎসকের পরামর্শে ল্যাব এইডে আসেন কিডনি রোগী অটোরিকশা চালক মুকিতুর রহমান (৩৮)। বলেন, অটো চালিয়ে সংসার চালাই। পরীক্ষা করাতেই টাকা শেষ। তাহলে চিকিৎসা কীভাবে করব, আর পরিবার নিয়ে কিভাবে চলব?

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা: বিএসএমএমইউয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান আমাদের সময়কে বলেন, এই সমস্যা দীর্ঘদিনের। মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুত একটি নীতিমালা করা। টেস্টের এমন উচ্চমূল্যের জন্য অনেক সময় চিকিৎসকদের ওপর দায় চাপানো হয়। কিন্তু কাজটা করছেন ব্যবসায়ীরা। আবার শুধু নীতিমালা করলেই হবে না, বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপও নিতে হবে।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, একই মানের প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ফির এমন স্বেচ্ছাচারিতা দুঃখজনক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন। হাসপাতালগুলোতে যাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।