বাংলা ব্লকেডে স্থবির দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
১১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বাংলা ব্লকেডে স্থবির দেশ


সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবিতে গতকাল ‘কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ডাকা হয়। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে সড়ক ও রেলপথ অবরোধসহ বিক্ষোভ সমাবেশ। এতে পুরো দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় নেমে আসে স্থবিরতা। নিতান্ত বাধ্য হয়ে যারা পথে পা রাখেন, তারা পড়েন যারপরনাই ভোগান্তিতে।

এদিকে এক দফা দাবি আদায়ে আজ বৃহস্পতিবারও সারা দেশে বাংলা ব্লকেড ডাকা হয়েছে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রাজধানীর শাহবাগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে এ ঘোষণা দেন কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।

আসিফ বলেন, বৃহস্পতিবার (আজ) বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে বাংলাদেশের সর্বত্র সড়কে ও রেললাইনে শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন। বিকাল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে আমরা ব্লকেড কর্মসূচি শুরু করব এবং সারাদেশের শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্লকেড কর্মসূচি সফলভাবে পালন করবেন।

আন্দোলনের এই সমন্বয়ক বলেন, আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় হাইকোর্টের বারান্দায় যেতে চাই না। আমরা আমাদের পড়ার টেবিলে থাকতে চাই, রুটিন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চাই। শিক্ষার্থীরা কোটার বিরুদ্ধে তাদের যে রায়, তা রাজপথে জানান দিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন দাবি না মানা পর্যন্ত। আমাদের দাবি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আমরা একদফা দাবি তুলেছি। সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসতে হবে যে- একটি কমিশন গঠন করে যৌক্তিক সমাধানের দিকে কোটা ব্যবস্থাকে নিয়ে যাবে সরকার।

গতকাল সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির কারণে অচল হয়ে পড়ে রাজধানীসহ পুরো দেশ। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাজধানীর জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্ট অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ফলে দিনভর যানজটে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি-সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢাকার সায়েন্সল্যাব মোড়, এলিফেন্ট রোড, শাহবাগ, মৎস্য ভবন মোড়, মিন্টু রোড, বাংলা মোটর, ফার্মগেট, আগারগাঁও ও মহাখালীর আমতলীসহ বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। মিরপুর রোড, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, এয়ারপোর্ট রোড, রামপুরা-বাড্ডা রোডসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো বন্ধ থাকায় যান চলাচল একরকম বন্ধ হয়ে যায়। ফার্মগেটে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নামার মুখ, হানিফ ফ্লাইওভারের মুখ, জিরো পয়েন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থান অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। এতে আশপাশের সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে হয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের কিছুটা দূরে পুলিশকে দলবেঁধে অবস্থান নিতে দেখা গেলেও তারা কোনো অ্যাকশনে যায়নি।

দক্ষিণাঞ্চলের সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনি, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল রুটের প্রবেশ দুয়ার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তানে গণপরিবহনের চলাচল স্বাভাবিকের চেয়ে কম দেখা গেছে। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড, রায়েরবাগ, শনির আখড়া ও কেরানীগঞ্জ, পোস্তগোলা, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকার কর্মস্থলে আসা মানুষের চাপ অনেক কম দেখা গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করায় যান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের

শিক্ষার্থীরা ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করে রাখেন। দুপুরে ঢাকার কারওয়ানবাজারেও রেলপথ আটকে দেওয়া হয়।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ‘সংবিধানের/মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘কোটা প্রথা, বাতিল চাই বাতিল চাই’, ‘কোটা প্রথার বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘কোটা না মেধা? মেধা মেধা’, ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’, ‘আপস না সংগ্রাম? সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’- ইত্যাদি সেøাগান দিতে থাকেন।

এদিকে গতকাল সকালে কোটার দাবিতে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান করছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে কোটাবিরোধী দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিল শাহবাগ মোড়ে আসার পর পুলিশের অনুরোধে ওই এলাকা ছাড়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। দুপুর ১২টার কিছু আগে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শাহবাগে মোড়ে এসে অবরোধ করলে পুলিশের অনুরোধে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থানকারীরা চলে যান।

রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টা থেকে আগারগাঁও মোড়ে অবস্থান নেন। এতে ফার্মগেট-মিরপুর, মহাখালী-মিরপুর রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

এর আগে ১০টার দিকে ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও বিভাগ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে মিছিল নিয়ে সংগঠিত হন শিক্ষার্থীরা। বিশাল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাহবাগে একটি অংশ এসে অবরোধ করে। বাকিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে। বিকাল ৩টায় রাজধানীর জিপিও পয়েন্টে অবরোধ করে রাখেন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর কর্মসূচি ঘোষণার পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে অবরোধ তুলে নেন শিক্ষার্থীরা।

মহাড়সক অবরোধ : রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ও রাজশাহী প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টা থেকে চার ঘণ্টাব্যাপী ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ১১টায় কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টা থেকে বিকাল পর্যন্ত নগরীর প্রবেশদ্বার মডার্ন মোড়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুর সাড়ে ১২টায় টাঙ্গাইল-আরিচা আঞ্চলিক সড়কের কাগমারি মোড় ও বেলা ১১টা থেকে ফরিদপুর শহরের মুজিব সড়কের সুপার মার্কেটের সামনে অবস্থান নেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এ ছাড়া পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টা থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক, মাদারীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টা থেকে ঘণ্টাব্যাপী মাদারীপুর-শরীয়তপুর সড়কের ডিসি ব্রিজ এলাকায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টায় প্রধান ফটকসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকাল ৪টায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ও টুঙ্গিপাড়া-গোপালগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে। এতে উভয় পাশে পাঁচ কিলোমিটার জানজট সৃষ্টি হয়।

বরিশাল : বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ১১টায় বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক, একই সময়ে বরিশাল সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ ও সরকারি টেক্সটাইল কলেজ শিক্ষার্থীরা মহাসড়কের চৌমাথায় এবং সরকারি ব্রজমোহন কলেজ ও সরকারি বরিশাল কলেজের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের সামনে মহাসড়কে অবস্থান নেন। এতে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধসহ বরিশাল নগরী কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১২ কিমি যানজট

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ, জেলার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টা থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা কোটবাড়ীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এতে মহাসড়কের দুই পাশে প্রায় ১২ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়।

রেলপথ অবরোধ : ময়মনসিংহে বেলা ১১টার দিকে ট্রেন থামিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টাব্যাপী রেলপথ অবরোধ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিকাল সোয়া ৫টার দিকে আন্তঃনগর তিস্তা ট্রেনটি ছেড়ে দেন শিক্ষার্থীরা। খুলনায় সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মহানগরীর নতুন রাস্তা এলাকায় সরকারি ব্রজলাল কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথ ও রেলপথ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নগরীর দেওয়ানহাট ওভার ব্রিজের নিচে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন। এতে নগরজুড়ে তীব্র যানজটের পাশাপাশি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-ঢাকা ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

অন্যদিকে কোটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে কটাক্ষ ও অবমাননার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও নগরীর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। তারা কটূক্তিকারীদের শাস্তি চেয়ে ১৯৭২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কতজন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান চাকরি পেয়েছে, তার শ্বেতপত্র প্রকাশসহ পাঁচটি দাবি পেশ করেন।

বিক্ষোভ সমাবেশ

নাটোর প্রেসক্লাব চত্বরে দুপুরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন নবাব সিরাজ উদ দৌলা সরকারি কলেজ ও সিংড়া গোলই আফরোজ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সামনে সকাল থেকে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।


প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রাম ব্যুরো, বরিশাল ব্যুরো, ঢাবি প্রতিবেদক, নিজস্ব প্রতিবেদক-ময়মনসিংহ; নিজস্ব প্রতিবেদক-ব্রাহ্মণবাড়িয়া; জবি প্রতিবেদক, রাবি প্রতিনিধি, ইবি প্রতিনিধি, বেরোবি সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি, ফরিদপুর প্রতিনিধি, খুলনা প্রতিনিধি, কুবি প্রতিনিধি, নাটোর প্রতিনিধি, পাবনা প্রতিনিধি, মাদারীপুর প্রতিনিধি, শেকৃবি সংবাদদাতা, জাবি প্রতিনিধি, বশেমুরবিপ্রবি প্রতিনিধি