স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে যত কিছু
স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিলে সেটাকে বলা হয় স্বেচ্ছামৃত্যু। তবে আমাদের দেশে সেটাকে বলা হয় আত্মহত্যা। সম্প্রতি স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের সত্তরোর্ধ্ব দম্পতি জ্যান ও এলস। জানা যায়, তারা প্রায় পাঁচ দশক ধরে
একসঙ্গে থেকেছেন, সংসার করেছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন। দুজনেই পানি পছন্দ করতেন, ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। এ কারণেই তারা ঘর বেঁধেছিলেন নৌকায়। থেকেছেন ক্যাম্পারভ্যানেও। হঠাৎই জুন মাসের শুরুতে নেদারল্যান্ডসের সত্তরোর্ধ্ব এই দম্পতি স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে ৩ জুন স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন জ্যান ও এলস দম্পতি। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ না। তার পরেও পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ঘটছে স্বেচ্ছামৃত্যুর ঘটনা। আমাদের আজকের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছামৃত্যুর হার নিয়ে ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন আজহারুল ইসলাম অভি
হাতে হাত রেখে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন প্রাক্তন ডাচ প্রধানমন্ত্রী
এই জীবন থেকে মরণও ভালো! একসঙ্গে এমনই এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দ্রিস ভান অঘট এবং তার স্ত্রী ইউজিনি। ৭০ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতিও টেনেছিলেন একসঙ্গে। হাতে হাত রেখে স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করেন তারা। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ দ্রিস-ইউজিনি আইনি পথে নিষ্কৃতি মৃত্যুর (ইউথেনেশিয়া) পথ বেছে নিয়েছিলেন। দুজনেরই বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। দীর্ঘ দিন ধরে তারা বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। দ্রিস একটি মানবাধিকার সংস্থার কর্ণধার ছিলেন। তাদের পক্ষ থেকে বিবৃতি প্রকাশ করে জানানো হয়েছে, কোনো ‘স্পেশাল ক্লিনিক’ নয়, গ্রামের বাড়িতেই নিষ্কৃতি মৃত্যুর পথ বেছেছেন দুজনে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মৃত্যুর সময়ও পরস্পরের হাত ধরে রেখেছিলেন দ্রিস-ইউজিনি। একই সঙ্গে বিষ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তারা মৃত্যুবরণ করেন। প্রসঙ্গত, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন দ্রিস। ‘ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাটিক আপিল পার্টি’র প্রতিষ্ঠাতা নেতাও ছিলেন তিনি। নিষ্কৃতি-মৃত্যুর প্রবণতা ক্রমশই বাড়ছে নেদারল্যান্ডসে। গত বছর সরকারি অনুমতি নিয়ে ২৯ যুগল স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন সে দেশে।
স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রথম বৈধতা
১৯৫৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলে বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছায় যন্ত্রণাহীন মৃত্যু আইন চালু হয়। কিন্তু আট মাস পর ক্যানবেরার ফেডারেল কর্তৃপক্ষ আইনটি বিলুপ্ত করে। এরপর একে একে কানাডা, নেদারল্যান্ড এবং বেলজিয়াম, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে মুমূর্ষু রোগীদের ডাক্তারি তত্ত্বাবধানে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর আইন পাস করা হয়। এইদিকে নাগরিকদের পরোক্ষ স্বেচ্ছামৃত্যু (প্যাসিভ ইউথানেসিয়া) চাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত।
রাশিয়া
সর্বোচ্চ স্বেচ্ছামৃত্যুর হারের তালিকায় আছে রাশিয়াও। দেশটিতে প্রতি বছর প্রতি লাখে প্রায় ২৫.১ জন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেয়।
আরও পড়ুন:
জলবায়ু সম্মেলনের আদ্যোপান্ত
লিথুয়ানিয়া
ইউরোপের মধ্যে এই দেশটিতেই আত্মহত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রতি লাখে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেন প্রায় ২৬.১ জন। সামাজিক ও আর্থিক সমস্যাই লিথুয়ানিয়ানদের আত্মহত্যার মূল কারণ। তবে সেখানে আত্মহত্যার হার ধীরে ধীরে কমছে বলে জানা গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা
আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকাকে চেনে না এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া দুষ্কর হবে। আফ্রিকানদের মধ্যেও ঢুকেছে স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রবণতা। জানা যায়, দেশটিতে স্বেচ্ছামৃত্যুর হার প্রতি লাখে ২৩.৫। সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়।
আরও পড়ুন:
এবারের সম্মেলনে গুরুত্ব পাবে যেসব বিষয়
ইসোয়াতিনি
আনুষ্ঠানিকভাবে ইসোয়াতিনি রাজ্য (সোয়াজি : উম্বুসো ভাসওয়াটিনি) নামে পরিচিত, এছাড়াও সোয়াজিল্যান্ড নামেও পরিচিত। এটি দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। দেশের জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ জাতিগতভাবে সোয়াজি। দেশের মূল ভাষা সোয়াজি (স্থানীয় আকারে সিসোয়াতি)। সোয়াজিরা ১৮তম শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগভানে তৃতীয়-এর নেতৃত্বের অধীনে তাদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১২ লাখের মতো। স্বেচ্ছামৃত্যুর দিক থেকে দেশটি আছে তালিকার ৩য় স্থানে। দেশটিতে গড়ে প্রতি ১ লাখে প্রায় ২৯.৪ জন স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়।
মাইক্রোনেশিয়া
মাইক্রোনেশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরের একটি অঞ্চল। এর পশ্চিমে ফিলিপাইন, দক্ষিণ-পশ্চিমে ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণে পাপুয়া নিউগিনি ও মেলানেশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্বে পলিনেশিয়া অবস্থিত। মাইক্রোনেশিয়া রাজনৈতিকভাবে অনেকগুলো সার্বভৌম দেশে বিভক্ত। এই অঞ্চলে প্রায় ২১০০ দ্বীপ রয়েছে যার সর্বমোট আয়তন প্রায় ২৭০০ বর্গকিলোমিটার। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গুয়াম যার আয়তন প্রায় ৫৮২ বর্গকিলোমিটার। এর জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার। দেশটিতে স্বেচ্ছামৃত্যুর হার ২৮.২ জন।
সুরিনাম
সুরিনাম বা সুরিনাম প্রজাতন্ত্র
আরও পড়ুন:
তাপমাত্রা যখন সর্বনিম্ন!
আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। ১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত সুরিনাম নেদারল্যান্ডসের একটি উপনিবেশ ছিল এবং তখন এর নাম ছিল ওলন্দাজ গায়ানা। সুরিনামের আয়তন ১,৬৩,২৬৫ বর্গ কিমি। এটি দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষুদ্রতম স্বাধীন রাষ্ট্র। সুরিনামের একমাত্র নগর এলাকা ও রাজধানীর নাম প্যারামারিবো। দেশটির জনসংখ্যা ৬ লাখ ২৮ হাজার ৮৩০। দেশটিতে স্বেচ্ছামৃত্যুর হার প্রতি লাখে ২৫.৪ জন।
লেসোথো
দক্ষিণ আফ্রিকার মানচিত্রের দিকে তাকালে চোখে পড়বে এক অদ্ভুত দৃশ্য। দক্ষিণ আফ্রিকার মাঝখান থেকে কিছু অংশ জুড়ে রয়েছে সম্পূর্ণ আরেকটি দেশ, নাম লেসোথো। লেসোথোকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। পৃথিবীতে এরকম চারিদিক থেকে ঘিরে থাকা দেশ আছে তিনটি। দ্বিতীয় নামটি হলো ভ্যাটিকান সিটি এবং স্যান ম্যারিনো। লেসোথোর মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ ৫৬ হাজার ২২৯ জন। পৃথিবীতে লেসোথোতেই একমাত্র দেশ যেখানে স্বেচ্ছামৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৭২.৪ জন মানুষ সেখানে গড়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়ে থাকেন।
গায়ানা
ক্যারিবীয় দেশ গায়ানায়ও আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। সেখানকার প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ৪০.৩ জনেরও বেশি আত্মহত্যা করে। গায়ানিজরা আত্মহত্যার মাধ্যম হিসেবে তরল বিষকেই বেছে নেয়। দারিদ্র্য ও অ্যালকোহল আসক্তির কারণে তারা আত্মহত্যার পথে পা বাড়ায়।
দক্ষিণ কোরিয়া
উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী এবং সবচেয়ে বড় শত্রু দক্ষিণ কোরিয়াতেও আত্মহত্যার হার খুব বেশি। সেখানে প্রতি এক লাখের মধ্যে ২৮.৬ জন আত্মহত্যা করছে। চাকরির নিশ্চয়তা না থাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার চাপ এবং নিঃসঙ্গতার কারণে তারা আত্মহত্যা করে। বিশেষ করে নভেম্বরে কলেজে ভর্তি পরীক্ষার আগে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বিষয়টি এতটাই উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে যে, সরকার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ওপর নজরদারি করে সম্ভাব্য আত্মহত্যা ঠেকানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।