সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরানের সঙ্গে ফাঁসছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা
ব্রাহমা কুকীর্তি
নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের ১৫টি গরু জবাই করে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে মাংস বিক্রি করার কথা থাকলেও সেগুলোকে সাদিক অ্যাগ্রোতে জ্যান্ত ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাণ্ডে জড়িত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা এবং খামারটির মালিক ইমরান হোসেন ফেঁসে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একাধিক অভিযানে ওঠে এসেছে সাদিক অ্যাগ্রোর ব্রাহমা কুর্কীতি।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, টানা কয়েকদিনের অভিযানে এ অনিয়ম-দুর্নীতি সংক্রান্ত নানা নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। কর্মকর্তারা কমিশনে প্রতিবেদনও দাখিল করেছেন। এখন যাচাই-বাছাই চলছে। এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই মামলা দায়ের করা হবে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ব্রাহমা গরুকাণ্ডের সঙ্গে সরকারি কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের দায়িত্বশীল ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত। ইমরান হোসেনসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে সরকারের ৪৪৮টি গবাদিপশুর (১৫টি ব্রাহমাসহ) মাংস বিক্রির নামে ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, সরকারের নির্দেশনা ভঙ্গ এবং অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার অভিযোগ আনা হচ্ছে।
দুদকের তথ্যানুযায়ী, ইমরান হোসেন ২০২১ সালে ‘শাহীওয়াল’ জাতের গরুর কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮টি ব্রাহমা জাতের গরু জাল কাগজপত্র তৈরি করে দেশে আনেন। কাস্টমস বিভাগ বিমানবন্দরে এসব গরু জব্দ করে। পরবর্তীকালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গরুগুলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়। পরে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে গরুগুলো কৌশলে ফের সাদিক অ্যাগ্রোকে নিয়ে যান।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়ে কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার, সাদিক অ্যাগ্রোর মোহাম্মদপুরের দুটি ও নরসিংদীর খামার, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কার্যালয়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস অফিসে অভিযান চালায় দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি টিম এসব অভিযানে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ৬টি ব্রাহমা জাতের গরু উদ্ধার করে সেগুলো জব্দ করেন। এ ছাড়া এ খামারে ব্রাহমা জাতের গরুর আরও ৭টি বাছুর পাওয়া যায়। অন্যদিকে, সাদিক অ্যাগ্রোতে ৫টি গাভীকে ব্রাহমা গরুর সিমেন (বীজ) দেওয়ার রেকর্ডপত্রও পেয়েছে দুদক। আরও কয়েক হাজার সিমেন সংগ্রহের আলামত পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন অভিযান দলের একাধিক সদস্য।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার খামারবাড়ি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে যায় দুদকের অভিযান দল। তারা গত রমজানে ব্রাহমা গরুসহ অন্যান্য গবাদিপশু জবাই করে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে নথিপত্র সংগ্রহ করেন। এর আগে গত ৩ জুলাই দুদক অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদপুরে সাদিক অ্যাগ্রো থেকে সেই ১৫টি গরুর মধ্যে ৬টি গরু উদ্ধার করে। এগুলো সরকারি খাতায় ‘জবাই করা হয়েছে’ বলে উল্লেখ রয়েছে। এরও আগে ১ জুলাই সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে ব্রাহমা জাতের সাতটি বাছুরের সন্ধান পায়। সেদিনের অভিযানে এ জাতের পাঁচটি গরুতে কৃত্রিম প্রজননের জন্য বীজ (সিমেন) দেওয়ার নথিপত্রও পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, অভিযোগ ছিল, ১৫টি ব্রাহমা গরুসহ সাড়ে ৪শ গবাদিপশু জবাই করে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা। কিন্তু সেখান থেকে ব্রাহমা গরুগুলো সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে নিয়ে আসা হয়। অভিযানে ৬টি ব্রাহমা গরু উদ্ধারও হয়েছে, জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও আমদানি করা হয়েছিল। যেগুলো সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক জবাই করে ন্যায্যমূল্যে ভ্রাম্যমাণ বিক্রিয়কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়ার কথা ছিল। সেসব নথিপত্র সংগ্রহ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এ নিয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী আইনি কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের দায়িত্ব ছিল গবাদিপশুগুলো সরবরাহ করা। এই গরুগুলো জবাই করার কথা ছিল, কিন্তু জবাই হয়নি। যার জিম্মায় ছিল (ইমরান হোসেন), তিনি সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করেননি।
গত রমজানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক সিদ্ধান্তে একটি কমিটি কর্তৃক বাছাই করে বুকভ্যালু পদ্ধতিতে ১৫টি ব্রাহমা গরুসহ সরকারি খামারের ৪৪৮টি গবাদিপশু বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনকে জবাই করে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ৬০০ টাকা দরে মাংস বিক্রির শর্তে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শর্ত অমান্য করে অন্য পশু জবাই করে ব্রাহমা গরুর মাংস বলে জানিয়ে দেন ইমরান হোসেন। বিষয়টি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দেখভাল করার কথা থাকলেও তারা দায়িত্ব অবহেলার করেন।
কোরবানির জন্য ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনার কাণ্ডের পর সাদিক অ্যাগ্রোর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জায়গা দখল করে খামার গড়ে তোলার অভিযোগ ওঠে। এরপর এ অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এরই মধ্যে নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু এ খামারে লালনপালনের ঘটনা বেরিয়ে আসে। কোরবানির ঈদে এ জাতের তিনটি গরু আড়াই কোটি টাকায় বিক্রি হওয়ার খবরও প্রকাশিত হয়। তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ইমরান গরুগুলোকে ‘বংশ মর্যাদাপূর্ণ’ গরু বলে পরিচয় দেন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে সরকার ব্রাহমা জাতের গরু বাংলাদেশে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ২০১৩ সালে বিফ-ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ প্রকল্পের গাইডলাইনে বলা হয়, কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে। ফলে এক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনার আপাতত কোনো সুযোগ নেই। দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্ধারিত গাভী পালন এলাকায় মাংস বৃদ্ধির জন্য গাভী পালন থেকে বিরত থাকতে হবে। অধিদপ্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুমোদন ছাড়া বিফ-ক্যাটল ডেভেলপমেন্টের অধীনে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না।