অর্থনীতি ছাপিয়ে কৌশলগত অংশীদারত্ব চায় বেইজিং

কাল চীন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

আরিফুজ্জামান মামুন
০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অর্থনীতি ছাপিয়ে কৌশলগত অংশীদারত্ব চায় বেইজিং

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে কাল চীন যাচ্ছেন। বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানের বাস্তবতায় গত মাসে ভারত সফর করে আসা প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এবারের সফরে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক সম্পর্ককে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘নিবিড় কৌশলগত অংশীদারত্বে’ রূপ দিতে চাইছে চীন।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের রাজধানী বেইজিং পৌঁছাবেন কাল। পর দিন তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠক শেষে চুক্তি ও সমঝোতা সই হবে। ১০ জুলাই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন চীনের পার্লামেন্ট ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস অব চায়নার প্রেসিডেন্ট ঝাও লেজির সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। বাংলাদেশের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাচ্ছেন। তারা সেখানে চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। আজ এই সফরের বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

সূত্র জানায়, চীন সফরে রোহিঙ্গা সমস্যা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি আলোচিত হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে ১৪টির মতো সমঝোতা হতে পারে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার চীন সফরে ২০টির মতো প্রকল্পে একমত হতে পারে ঢাকা-বেইজিং। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক চুক্তিসই অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কীভাবে আরও গভীর করা যায় এবং উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক সহযোগিতা সম্প্রসারণ ও অভিন্ন স্বার্থের আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে মতবিনিময় করবেন দুই দেশের নেতারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগবিষয়ক একটি সম্মেলনেও যোগ দেবেন।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে অবধারিতভাবে তিস্তা প্রকল্প প্রসঙ্গটি আসবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়। তিস্তা প্রকল্পে ভারতের প্রস্তাব সামনে আসার পর এ প্রকল্পে চীনের প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি বাংলাদেশ জানাতে পারে এবারের শীর্ষ বৈঠকে। ইতোমধ্যে ১৪টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের পানির তথ্য সরবরাহসংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে। সমঝোতা অনুযায়ী, বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণে বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাভাস জানাবে চীন। কারণ ব্রহ্মপুত্র নদের অর্ধেক অংশ রয়েছে চীনে। বাকি অর্ধেক বাংলাদেশ ও ভারতে। ফলে উজানের পানিতে দেশে বন্যা হওয়ার শঙ্কা থাকে। এ জন্য চীনের পূর্বাভাস পেয়ে বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া যাবে। এ ছাড়া চীনের কাছ থেকে বাণিজ্য সহায়তা ও বাজেট সহায়তার আওতায় ঋণ, বিনিয়োগ সুরক্ষা, ডিজিটাল অর্থনীতি, ব্লু ইকোনমি, মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সমীক্ষার ঘোষণা এবং একাধিক সেতু নির্মাণ ও সংস্কার ইত্যাদি প্রসঙ্গ রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত সমন্বিত প্রকল্পে চীনের সহায়তাও চাওয়া হবে।

সূত্র জানায়, বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক চাপ থেকে উত্তরণে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ চাইতে পারে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে। এবারের সফরের বিশেষ দিকটি হবে আর্থিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য চীনের ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৪০ কোটি ইউয়ানের বেশি ঋণ। এর মধ্যে বাণিজ্য সহায়তার আওতায় ৫০০ কোটি ডলার ও বাজেট সহায়তার আওতায় ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় বাংলাদেশকে ঋণ দেবে চীন। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যেভাবে টাকা-রুপিতে লেনদেনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতায় টাকা-ইউয়ানে লেনদেনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।

প্রতিবেশী মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এবং বাংলাদেশে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন কক্সবাজার এলাকার সামাজিক কাঠামোকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। ঢাকা এই সংকট সমাধানে বেইজিংয়ের সক্রিয় উদ্যোগের জন্য অনুরোধ করবে। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে ৬১০.১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, চীন থেকে মোট ১৭৮২৬.৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যার ফলে ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। এই সংকট সমাধানে বেইজিংয়ের সক্রিয় উদ্যোগের জন্য অনুরোধ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। চীনের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার সমাধান করতে চীনা উদ্যোক্তাদের প্রতিশ্রুতিশীল খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হবে।