ব্রিটিশ রাজনীতিতে লাল গোলাপের সৌরভ

চিররঞ্জন সরকার
০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ব্রিটিশ রাজনীতিতে লাল গোলাপের সৌরভ

ব্রিটিশ রাজনীতিতে নতুন হাওয়া। একে অনেকেই বলছেন ‘লাল ঝড়।’ বিশ্বজুড়ে ডানপন্থি রাজনীতির একটা ঝড় বইছে দুই দশক ধরে। রাজনৈতিক চিত্র বলছে, ডাননীতিতেই ঝুঁকছে বেশি মানুষ। এই আবহে অন্য ছবি দেখাল ব্রিটেন। দীর্ঘ ১৪ বছর পর আবারও সেখানে লাল ঝড়। মিডিয়া, নির্বাচনবোদ্ধা, বুথ ফেরত জনমত জরিপের পূর্বাভাস মিলিয়ে রাজার দেশে ধরাশায়ী ডানপন্থি কনজারভেটিভ পার্টি। পরিবর্তনের ঝড় উঠেছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মসনদে বসছেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। ডানপন্থি হাওয়ার মধ্যে ব্রিটেনের মানুষ আবারও ভরসা রাখলেন মধ্য বামপন্থি হিসেবে পরিচিত লেবার দলের ওপর। আর লাল গোলাপ ব্রিটিশ লেবার পার্টির প্রতীক। এবার ব্রিটেন যেন এই লাল গোলাপের সৌরভে মাতোয়ারা।

ব্রিটেনে ক্ষমতার পালাবদল হলো ১৪ বছর পর। কনজারভেটিভ পার্টি (টোরি)-কে হারিয়ে নিরঙ্কুশ জয়ের পর লেবার পার্টির প্রধান কিয়ার স্টারমার সে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন। টোরি নেতা তথা ব্রিটেনের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকের স্থলাভিষিক্ত হলেন স্টারমার।

২০১০ সালে ডেভিড ক্যামেরনের হাত ধরে ব্রিটেনে শুরু হয় কনজারভেটিভ পার্টির শাসন। তার পর একে একে ক্ষমতায় বসেন থেরেসা মে, বরিস জনসন, লিজ ট্রাস এবং সব শেষে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ঋষি সুনাক ক্ষমতায় বসেন। সুনাকের ২ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া এই নির্বাচনে বামপন্থি মনোভাবাপন্ন লেবার পার্টি (এখন পর্যন্ত যেসব আসনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে, তার মধ্যে) ৪১২টি আসন পেয়েছে, যা পাঁচ বছর আগের পরিসংখ্যান থেকে এক প্রকার বিস্ময়কর উত্থান বলা যেতে পারে।

১৪ বছর ধরে কৃচ্ছ্রসাধন, ব্রেক্সিট, মহামারী, রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে ভোটাররা কনজারভেটিভদের যেন শাস্তি দিল। এটি তাদের জন্য একটি বিপর্যয়। দলটি এবার মাত্র ১২১টি আসনে জয়লাভ করেছে।

ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী স্টারমার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ও ধীরস্থির নেতা হিসেবে পরিচিত।

গর্ডন ব্রাউন যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় ২০০৮ সালে স্টারমারকে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের পাবলিক প্রসিকিউটরের অধিকর্তা নিয়োগ করা হয়। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত স্টারমার সাংসদদের তাদের খরচের অপব্যবহারের জন্য, ফোন হ্যাকিংয়ের জন্য সাংবাদিকদের এবং ইংল্যান্ডজুড়ে অশান্তিতে জড়িত তরুণ দাঙ্গাবাজদের বিচারের তদারকি করেছেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু খুব কমই তিনি ‘স্যার’ উপাধি ব্যবহার করেন। ২০১৫ সালে তিনি উত্তর লন্ডন আসন থেকে সংসদে নির্বাচিত হন।

৮৫ বছরের ইতিহাসে সব থেকে খারাপ পরাজয়ের মুখে পড়ার পর ২০২০ সালে স্টারমারকে লেবার পার্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্টারমার এবং লেবারও কনজারভেটিভ পার্টির অধীনে বছরের পর বছর চলতে থাকা অর্থনৈতিক যন্ত্রণা এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাকে পুঁজি করেছে।

এবারের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবি হয়েছে। এই ভরাডুবির পেছনে মূল কারণ দলটির অভিজ্ঞ নেতাদের এবারের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া। কনজারভেটিভ পার্টির রেকর্ডসংখ্যক পুরনো এমপি এবার আর লড়েননি। 

সদ্য সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান ঋষি সুনাকের আকস্মিক নির্বাচন ঘোষণার বিষয়টি দলের অনেকেরই পছন্দ হয়নি। এই বিষয় নিয়ে অসন্তোষ ছিল দলের ভেতরে। এ ছাড়া দলের ভেতরে শৃঙ্খলার অভাব, সততার অভাব ইত্যাদি বিষয়ও দলটির নির্বাচনী যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। 

নির্বাচনী প্রচারেও নিষ্প্রভ ছিল কনজারভেটিভ পার্টি। মূলত ঋষি সুনাকই এর জন্য বেশির ভাগ দায়ী। তিনি নিজেও নির্বাচনী প্রচারণায় খুব একটা ক্যারিশমা দেখাতে পারেননি। এ ছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি মোকাবিলা করতে ও দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি, তা হলো অর্থনীতি। 

লেবার পার্টি যেখানে অর্থনৈতিক সংস্কার, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে তাদের করণীয় অনেকটাই স্পষ্টভাবে হাজির করেছে তরুণ ভোটারদের সামনে, সেখানে এ ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি। আর এসব কারণই মূলত দলটিকে ভরাডুবির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য নানাদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। দেশটিতে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসী বাস করেন। লেবার পার্টি মূলত অভিবাসনবান্ধব দল হিসেবে পরিচিত। ব্রিটেনে বসবাসরত প্রবাসীদের মধ্যে বৃহত্তম বাংলাভাষীদের বড় অংশের সমর্থন রয়েছে লেবার পার্টির দিকেই। সেদিক থেকে লেবার পার্টির বিজয়কে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য সুসংবাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এবারের নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভত ব্রিটিশ নাগরিক অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে লেবার পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন সর্বোচ্চ ৮ জন। তাদের মধ্যে বর্তমান এমপি রুশনারা আলী, রুপা হক, টিউলিপ সিদ্দিক ও আপসানা বেগমসহ লেবার পার্টি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন। এটা অভিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সুসংবাদ।

তবে বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা লেবার পার্টিকে এখন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মনোনিবেশ করতে হবে। যুক্তরাজ্য মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগেছে। ২০০৮ সালের পর অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে বেরোতে পারেনি দেশটি। টোরি দল ক্ষমতায় থাকাকালে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়েছে। আরেকটি মৌলিক সত্য হচ্ছে যুক্তরাজ্যে বৈষম্য বেড়েছে এবং উৎপাদনশীলতা কমেছে। প্রকৃত মজুরি স্থবির হয়ে পড়েছে। 

ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময় থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যাসহ সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের জনগণ বিরক্ত হয়ে এবার ক্ষমতার পালাবদল চেয়েছে। জনপ্রত্যাশা পূরণে লেবার পার্টিকে এখন অগ্রাধিকার ঠিক করে এগোতে হবে।

নির্বাচনের আগে স্টারমার গাজা হামলায় ইসরায়েলকে সমর্থন এবং অভিবাসনবিরোধী কড়া অবস্থান প্রকাশ করেছেন। এখন তার সে অবস্থান বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক কিছুই বদলাতে হবে। এতে বিরোধ-বিসম্বাদও বিচিত্র নয়। সেটা লেবার পার্টির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ব্রিটেনের নির্বাচনে যেসব বিষয় শিক্ষণীয় হিসেবে দেখা দেয়, সেগুলো হলো- নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভোট গণনা, ফল ঘোষণা সবকিছু পূর্বনির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হয়, কোথাও কোনো হাঙ্গামা হয় না। পরাজিত হলে ফলাফল মেনে নিয়ে পরাজিত দল বিজয়ী দলকে অভিনন্দিত করে। আমাদের গণতন্ত্র অনেকটাই ব্রিটিশ ধাঁচের। কিন্তু এই গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি আমরা। ব্রিটেনের নির্বাচন আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির উন্নয়নে প্রেরণার উৎস হতে পারে। পরিশেষে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত নতুন সরকারের আমলে বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও বেগবান হোক, এই প্রত্যাশা করি।


চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক