টাকা হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছে
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আস্থার সংকটে নগদ টাকা হাতে রাখতেই পছন্দ করছে মানুষ। গত বছর নভেম্বর থেকে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সর্বশেষ মে মাসেও ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ৭ মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কিছু কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে হাতে রাখছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর প্রভাবে মানুষ নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছেন না। এছাড়া আস্থা সংকট ও দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ বিষয়ক আতঙ্কেও আমানত তুলে নেওয়া হতে পারে। আরেকটা কারণ ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এছাড়া দুই ঈদের আগেও নগদ টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগদ তথ্য বলছে, গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা, যা মে মাস শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। ফলে এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের বাইরে অর্থ বেড়েছে ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। এসব টাকা আর ওই মাসে ব্যাংকে ফেরত আসেনি। এ নিয়ে টানা ৭ মাস ধরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বাড়তে দেখা গেল। মূলত গত বছর নভেম্বর থেকে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বাড়তে শুরু করে। অন্যদিকে একই সময় থেকে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, মে মাস পর্যন্ত মোট মুদ্রার (ব্রড মানি) সরবরাহ ছিল ১৯ লাখ ৭১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের বাইরে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা এবং বাকি ১৭ লাখ ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা ব্যাংকগুলোতে জমা ছিল। এর মধ্যে ডিমান্ড ডিপোজিট ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা এবং টাইম ডিপোজিট ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর অক্টোবরের পর থেকেই ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বাড়ছে। ওই মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। নভেম্বরে তা বেড়ে হয় ২ লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে আরও বেড়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি, জানুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি, মার্চে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি, এপ্রিলে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি এবং সর্বশেষ মে মাসে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৭ মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে ২৪ হাজার ৭১৫ কোটি।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সুদের হার বৃদ্ধির পরও আশানুরূপ আমানতের দেখা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। চলতি বছর মার্চ থেকে সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো ঋণ ও আমানতের সুদহার বাড়াতে পারছে। বর্তমানে আমানত সংগ্রহে কোনো কোনো ব্যাংক ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। এতে আমানত যেভাবে আকৃষ্ট হওয়ার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর মে শেষে ব্যাংকখাতে আমানত দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৬০৮ কোটি টাকা, যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ১৫ লাখ ৬৩ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। ফলে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮.৭৭ শতাংশ। এক মাস আগে এপ্রিল পর্যন্ত বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৬৩ শতাংশ। অথচ গত বছর নভেম্বর থেকে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো মাসেই আমানতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের নিচে নামেনি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমানতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০.৪৩ শতাংশ। আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ১০.৫৭ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। ২০২১ সালের মে মাসে এ খাতে আমানতে প্রবৃদ্ধি উঠেছিল সর্বোচ্চ ১৪.৪৭ শতাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, সুদহার বৃদ্ধির পরও আমাদের প্রবৃদ্ধি কমার অর্থ হচ্ছে- গ্রাহকের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। একীভূত ইস্যুতে বেশকিছু ব্যাংকের গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গ্রাহকের আমানত দিতে পারছে না কিছু ব্যাংক, এমন ঘাটনাও ঘটছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, এতে সঞ্চয় কমেছে অনেকের। কেউ কেউ সঞ্চয় ভেঙেও খাচ্ছেন, যার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধিতে।
এদিকে গত এপ্রিল শেষে ব্যাংকগুলোর ঋণ ও বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ২০ লাখ ২৯ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা মে মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এক মাসে ঋণ ও বিনিয়োগ বেড়েছে ২৬ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধির হার ১১.৫২ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটেও পড়েছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত ধার করতে হচ্ছে।