স্বাবলম্বী হচ্ছেন সুবর্ণচরের কৃষক

সর্জান পদ্ধতিতে মাছ ও সবজির চাষ

আরিফুর রহমান, সুবর্ণচর (নোয়াখালী)
০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
স্বাবলম্বী হচ্ছেন সুবর্ণচরের কৃষক

সবজির সঙ্গে সমন্বিতভাবে করা হচ্ছে হাঁস ও মাছের চাষ। ইন্দোনেশিয়ার ২০০ বছরের পুরনো এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পতিত জমিতে সুস্বাদু সবজি চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন সুবর্ণচরের কৃষকরা।

ইন্দোনেশিয়ার সমন্বিত এই চাষপদ্ধতির নাম সর্জান, যার অর্থ- কাপড়ের রঙিন ডোর (স্ট্রাইপ)। দেশটির জাভা অঞ্চলের কৃষকরা ২০০ বছর ধরে এই পদ্ধতিতে হাঁস, মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ করছেন।

সর্জান পদ্ধতিতে একটি জমির মাটি কেটে সেই জমিতে পাঁচ থেকে ছয় ফুট দূরে দূরে লম্বা ডোরের (স্ট্রাইপ) মতো ঢিবি করা হয়। তার নিচেই থাকে সরু নালা। ঢিবিতে সবজি লাগানো হয় আর নালার পানিতে মাছ ছাড়া হয়। নালা সংযুক্ত থাকে পুকুরের সঙ্গে। কেউ কেউ এই জমির চারদিকে জালের বেড়া দিয়ে হাঁসের খামারও সংযুক্ত করে দেন। এভাবে উঁচু ঢিবিতে সবজি লাগানোর ফলে লবণপানি সবজি গাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না এবং মাটি ওলট পালট করার কারণে মাটির লবণাক্ততা কমে গিয়ে উর্বরতা বাড়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় একটা সময় আমন ধান ঘরে তোলার পর পতিত হিসেবে থাকত সুবর্ণচরের জমি। এখন সেখানে বিশেষ পদ্ধতিতে হাঁস, মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ শুরু হয়েছে।

সুবর্ণচর কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৪০ হাজার ৪৬৪ হেক্টর। এর মধ্যে ৩৮ হাজার ৭১০ হেক্টরে আমন মৌসুমে ধান চাষ হয়। আর অন্যান্য মৌসুমে ৫ হাজার হেক্টরে সবজির চাষ হয়।

২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে সর্জান পদ্ধতিতে সবজি চাষ হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে সুবর্ণচরে সর্জানের বিকাশ ঘটে। চলতি বছর এটি অনেকটাই বেড়েছে এবং ক্রমাগত বাড়বে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ। তিনি আরও বলেন, কৃষকরা এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে কয়েক গুণ বেশি লাভবান হচ্ছেন, তাই পদ্ধতিটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।

সুবর্ণচরের চর আমানুল্লাহ গ্রামের কৃষক ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে আলাপ এবং তার ফসলি জমির খেত দেখে কৃষি কর্মকর্তার বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেল। লবণাক্ততার কারণে আমন ধান ঘরে তোলার পর বছরের বাকি সময়ে জমি অনাবাদি পড়ে থাকত ইলিয়াসের। ছয় একর জমি বছরের সাত-আট মাস ফেলে রাখার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি। সাত বছর আগে ভোলার চরফ্যাশন থেকে আসা এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে মাছ, হাঁস এবং সবজির সমন্বিত চাষের কথা জানতে পারেন তিনি। সেই পদ্ধতিতে তিনি এখন বছরে চারবার ফসল ঘরে তোলেন।

ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আগে একরে শুধু ৩০-৪০ মণ ধান পেতাম। তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলত। এখন সবজি চাষ করে একরপ্রতি ৪০-৫০ হাজার টাকা ব্যয় করে বছরে আয় করি এক থেকে দেড় লাখ টাকা।’

অবশ্য বছর দশেক আগে এই পদ্ধতিতে শুধু পুকুরপাড়ে চাষাবাদ করতেন সুবর্ণচরের কৃষকরা। লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা অন্যান্য ফসলের জমিতেও এখন এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন।

মাহবুব সর্দার ছিলেন ভোলার শাহবাজপুরের বাসিন্দা। জমিসংকটের কারণে সত্তরের দশকে সেখান থেকে সুবর্ণচরে চলে আসেন। পরে জমি কিনে পূর্ব চরবাটা এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসত গড়েন তিনি। এখন উপজেলার সেলিমবাজারের দক্ষিণ মাথায় একটি ছোট চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। সেখানে বসে কথা হয় তার সঙ্গে।

মাহবুব সর্দার বললেন, ‘জমি কেনার পর সেখানে অনেক বছর ধরে শুধু আমন চাষ করেছি। ১০-১৫ বছর আগে ভোলা থেকে আমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কয়েকটি পরিবার এখানে আসে। তারা জমি বর্গা নিয়ে সর্জান পদ্ধতিতে চাষ করা শুরু করে। পরে সরকারি-বেসরকারি কৃষি কর্মকর্তারা সর্জান পদ্ধতির ওপর ট্রেনিং দেন। তাদের দেখাদেখি আমিও দেড় একর জায়গায় সবজি চাষ শুরু করি। এখন নিয়মিত লাউ, শসা, করলা, শিমসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করি।’

উপজেলা কৃষি কার্যালয় বলছে, কৃষকদের আগ্রহ, সরকারের কৃষি বিভাগ এবং কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার যৌথ প্রয়াসে এই সর্জান পদ্ধতি দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

সবজি যাতে সঠিকভাবে বাজারজাত করা হয়, সে জন্য ১২টি স্থানে সবজি বিপণন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, সুবর্ণচরে উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি গত দুই-তিন বছরে অল্প পরিমাণে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইতালির এথনিক মার্কেটে রপ্তানি করেছেন কৃষকরা। ২০২৫ সাল নাগাদ পুরোদমে সবজি রপ্তানির লক্ষ্য সামনে রেখে এ বছর প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেখানকার কৃষকরা।