বঙ্গবন্ধুর জীবন্ত রূপ

রায়হান উদ্দিন, চট্টগ্রাম
০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বঙ্গবন্ধুর জীবন্ত রূপ

পরনে কালো স্যুট। পরিপাটি চুল। সৌম্য চাহনি। হাতে কালো চশমা। কিছুটা বাঁকানো কাঁধ। ভঙ্গিমায় প্রত্যয়ী। স্থির হয়ে বসে আছেন সোফায়। বয়স ৫০ ছুঁইছুঁই। প্রথম দেখায় যে কেউ মনে করবেন রক্তে মাংসে গড়া জীবন্ত বঙ্গবন্ধু। ঘোর কাটতেই বোঝা যাবে তিনি বসে আছেন ঠিকই; তবে জীবন্ত নয়, শিল্পীর ভাস্কর্য হয়ে। শুধু প্রাণ ফুঁকে দিলেই আলোচনা জুড়ে দিবেন তার স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এমন অনন্য ভাস্কর্যের দেখা মিলবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নির্মিত আর্টিলারি জাদুঘরে।

চট্টগ্রামের হালিশহর সেনানিবাসে নবনির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্যাটারি কমপ্লেক্সের নিচতলায় স্থাপন করা হয়েছে আর্টিলারি জাদুঘর। জাতির পিতার অকৃত্রিম অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে এবং তার স্মৃতি, চেতনাকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে জীবন্ত এ প্রতিকৃতি। লন্ডনে অবস্থিত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় মাদাম তুসো জাদুঘরে রক্ষিত ভাস্কর্যের আদলে বঙ্গবন্ধুর অতিবাস্তব ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছে; যা চট্টগ্রাম আর্টিলারি সেন্টার ও স্কুলের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএনএম মনজুরুল হক মজুমদারের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধানে চীন থেকে প্রস্তুত করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রেজিমেন্ট অব আর্টিলারির উৎপত্তির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার নামানুসারে ১৯৭১ সালে গঠিত রেজিমেন্ট অব আর্টিলারির প্রথম ফিল্ড ব্যাটারির নামকরণ করা হয় ‘মুজিব ব্যাটারি’। এই স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে বঙ্গবন্ধুর এই প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে আর্টিলারির জাদুঘরটিতে। গত ২১ এপ্রিল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে শিগগিরই জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে।

নির্মাণের বিশেষত্ব : মাদাম মেরি তুসো সম্পর্কে সবারই কম বেশি জানা আছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ফরাসি এই নারীর প্রতিষ্ঠিত সংগ্রহশালাটিই পরবর্তী সময়ে মাদাম তুসো জাদুঘর নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। এখানে সহজেই দেখা মিলবে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন থেকে সময়ের বিশ্বসেরা ফুটবলার মেসিকেও। রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র তারকা, তারকা খেলোয়াড় থেকে শুরু করে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মূর্তিও সযত্নে রক্ষিত আছে জাদুঘরটিতে। মাদাম তুসো নিজের জীবনের সমস্ত শ্রম দিয়েছেন এ মোমের মূর্তি তৈরির পেছনে। মানুষের হুবহু অবয়ব ফুটে ওঠে তার সৃষ্টিতে। যেন প্রতিটি ভাস্কর্য একেকজন জীবন্ত মানুষ। সেই মাদাম তুসোর ভাস্কর্যের অনুরূপ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়েছে আর্টিলারি জাদুঘরে। সিলিকনের তৈরি এ ভাস্কর্যে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত পোশাক, চশমা, পাইপ ও জুতার সঙ্গে সাদৃশ্য রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অতিবাস্তব প্রতিকৃতিটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে ২ মাস ১০ দিন।

চেহারায় হাসি : ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্থির, দৃঢ় এবং কোমল হৃদয়ের মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। আনুষ্ঠানিকতার কমই ধার ধারতেন তিনি; তার মধ্যে ছিল আলাপচারিতার প্রাবল্য। তিনি যেখানেই যান, সেখানেই ধ্বনিত হতো তার সুউচ্চ কণ্ঠস্বর। এ কণ্ঠে হাস্যরস যুক্ত হলে ফল হতো চমক জাগানিয়া। বঙ্গবন্ধুর রসবোধ ছিল কিংবদন্তিতুল্য। আলাপের সময় ভেতর থেকে আসত তার হাসি। দেশ ও জনগণের প্রতি তার স্নেহ ও মমতা ছিল অসীম; যা সর্বদা তার অভিব্যক্তিতে প্রস্ফুটিত হতো। এসব বিষয় মাথায় রেখে মধ্য বয়সী (৪৭ বছর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখের অভিব্যক্তিকে ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ভাস্কর্যে বঙ্গবন্ধুর পাইপ, চশমা ও বসার ভঙ্গিমা : স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতার নজির অতুলনীয়। জাতির পিতার দৃঢ় নেতৃত্বের প্রতিফলন জীবন্ত এই ভাস্কর্যটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের মধ্যকার মতবিনিময়কালীন একটি স্থিরচিত্রের অনুরূপ। সেটা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম আমেরিকা সফর। টোব্যাকো পাইপ হাতেই হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে প্রবেশ করেছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশের সুদর্শন স্মার্ট প্রধানমন্ত্রী। হোয়াইট হাউসে জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে কথা বলার সময় পা আড়াআড়ি করে বসেছিলেন। সেখানেও ছিল পুরনো কারিশমা। ছিল ব্যক্তিত্বের সহজাত বৈশিষ্ট্য। হুবহু সে দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে ভাস্কর্যটিতে। অন্যদিকে দরাজ কণ্ঠ ও পুরনো ফ্রেমের চশমা তার ব্যক্তিত্বে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।

দেয়াল ও মেঝেতে আছে স্মরণীয় ইতিহাস : বঙ্গবন্ধুর অতিবাস্তব এ প্রতিকৃতিটির পেছনে নির্মিত দেয়াল ও মেঝে স্মরণ করিয়ে দিবে এক করুণ ইতিহাসের কথা। যা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির ড্রয়িংরুমের আবহে স্থাপন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়িটি বাঙালির জাতিসত্তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তির ঠিকানা। এখান থেকেই বাঙালি জাতি পেয়েছিল মুক্তির দিকনির্দেশনা ও স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিলেন স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড ও লাল-সবুজের পতাকা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হন বাড়িটিতে। সেই স্মৃতি ধরে রাখতেই জাতির পিতার অতিবাস্তব প্রতিকৃতি স্থাপন করা কক্ষটির দেয়াল ও মেঝে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির বাসভবনের আবহে স্থাপন করা হয়েছে।