কোণঠাসা জঙ্গিরা সক্রিয় অনলাইনে

সাজ্জাদ মাহমুদ খান
০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কোণঠাসা জঙ্গিরা সক্রিয় অনলাইনে

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ প্রাণঘাতী হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক কঠোর অভিযানে জঙ্গি তৎপরতা কমে গেছে। দেয়াল লিখন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিদের সরাসরি কার্যক্রম স্থবির। কিন্তু এখনো অনলাইনে সক্রিয় জঙ্গিরা। ছোট ছোট সিক্রেট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা অপতৎপরতা চালাচ্ছে। অনলাইনে সক্রিয় এমন অর্ধশতাধিক জঙ্গিকে গত ছয় মাসে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তবে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব নামের দুই জঙ্গিকে ১৯ মাসেও গ্রেপ্তার করা যায়নি। জঙ্গি নেতা মেজর জিয়ারও হদিস মিলছে না। এ ছাড়া জামিনে ছাড়া পাওয়া জঙ্গিদের ওপর নজরদারিতে দুর্বলতা নাশকতার সুযোগ তৈরি করতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর নড়েচড়ে বসেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও জঙ্গিদের সুপথে ফেরাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু করা হয়েছিল সচেতনতা কার্যক্রম। এ ছাড়া জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া তরুণদের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ধর্মীয় প-িত, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, আইন উপদেষ্টা ও মনোবিদদের মাধ্যমে কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে। যার সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদ শেষ হয়ে না গেলেও বড় ধরনের হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা হারিয়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলো।

জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গিদের ফিজিক্যাল একটিভিটি নেই বললেই চলে। তারা অনলাইনে সক্রিয় আছে। অনলাইনে একে অপরের সঙ্গে ট্রেনিং মডিউল শেয়ার করছে। নতুন সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কোনো জঙ্গি সংগঠনেরই বড় ধরনের হামলা করার সক্ষমতা নেই। গত কয়েক বছরে বড় ধরনের কোনো হামলা চালাতে পারেনি জঙ্গিরা। গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের অবস্থান ভালোর দিকে যাচ্ছে প্রতিবছর। নব্য জেএমবি বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটে আছে। আনসার আল ইসলামের কার্যক্রমও শুধু অনলাইনভিত্তিক।

কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জঙ্গিবাদে জড়ানো ৬৮ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছর। আর ৮২ শতাংশই জঙ্গিবাদে জড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তরুণদের ধর্মের ভুল বা অপব্যাখ্যা দিয়ে আত্মঘাতী হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকে তাদের বের করে নিয়ে আসাই প্রকৃত সমাধান। তাদের যদি ডিরেডিক্যালাইজড করতে পারি, তাহলে যে অবস্থা বর্তমানে বিরাজ করছে, সেই অবস্থা অব্যাহত থাকবে। কাউন্সেলিংয়ের কারণে অনেকেই একটা সময়ে এসে তাদের ভুল বুঝতে পারছেন। গাজীপুর কাশিমপুর কারাগারে জঙ্গিদের ডিরেডিক্যালাইজেশনের কাজ চলছে। এখানো যাদের সাজার মেয়াদ শেষ হতে আরও ১-২ বছর লাগবে, তাদের নিয়ে এ কর্মসূচি চালু করেছে সিটিটিসি।

এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ জঙ্গি সদস্যকে ডিরেডিক্যালাইজড করা হয়েছে জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, চলতি অর্থবছরে ৫৪ জঙ্গিকে ডিরেডিক্যালাইজড প্রোগ্রামের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়া কাশিমপুর কারাগারে ৮ জন করে দুটি ব্যাচে আরও ১৬ জঙ্গিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম।

জানা গেছে, যাদের বিষয়ে কাউন্সেলররা ডিরেডিক্যালাইজড বলে মতামত দেন, তাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে যে যেটা শিখতে আগ্রহী, তাকে সে বিষয়েই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গাড়ি চালনা, কম্পিউটার ও টেইলারিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হবে।

হলি আর্টিজান হামলার বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার মামলায় তদন্তকাজ শেষ করে সিটিটিসি। এর সঙ্গে জড়িত মাস্টারমাইন্ড পাঁচজন অপারেশনের সময় নিহত হন। পরে এই হামলার সঙ্গে জড়িত হোতাদের আটজনকে জীবিত গ্রেপ্তার করা হয়। সেই মামলায় সাতজনকে ফাঁসি ও একজনকে খালাস দেন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করেন। সেই রায়ে আমৃত্যু কারাদ- দেন হাইকোর্ট।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, তাদের দেওয়া তথ্যে নব্য জেএমবির সর্বশেষ আমির মাহাদী হাসান জনিকে তুরস্কের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। পরে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। বর্তমানে জঙ্গিরা অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। এর বাইরে আনসার আল ইসলাম সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে বর্তমানে জঙ্গিদের বড় কোনো হামলা ও সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নেই। তারা বেশি সক্রিয় সাইবার স্পেসে। তাদের সদস্য সংগ্রহ, প্রচারণা ও প্রশিক্ষণÑ সবকিছুই সাইবার স্পেস নির্ভর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সাইবার স্পেসকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। সার্বক্ষণিক অনলাইন সার্ভেইলেন্স চলছে, সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে চলছে অভিযানও।

২০২২ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের সামনে হামলা চালিয়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। এ ঘটনায় ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে পলাতক দুই জঙ্গি ১৯ মাসেও গ্রেপ্তার হয়নি।

এ বিষয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, তাদের গ্রেপ্তারে ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ ও সাভারসহ কয়েকটি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু অভিযানের আগেই তারা স্থান পরিবর্তন করে ফেলেছে। তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। একই সঙ্গে তাদের ডির‌্যাডিক্যালাইজেশনের কাজ চলছে। জামিনে বের হয়ে এসে যাতে নতুন করে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে না পারে বা সংগঠিত হতে না পারে তা নজরদারি করা হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের ওয়ার্ড মেম্বারসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকে কার্যক্রমে যুক্ত করে সচেতনতার কাজ করা হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ করে আসা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় এখন অনেক বেশি সংগঠিত। এই দলের সদস্যরা অন্যদের তুলনায় শিক্ষিত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন। এ দলের শীর্ষ নেতা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত পলাতক মেজর জিয়াও অনেক বেশি প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞানসম্পন্ন। ফলে সংগঠনের সদস্যদেরও সে সেভাবেই তৈরি করেছে। দীর্ঘ চেষ্টায়ও মেজর জিয়া গ্রেপ্তার না হওয়ায় এই জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম এখনো সক্রিয়।