আতঙ্কে রাজস্ব বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা

মতিউর-ফয়সালেই শেষ নয়, ফাঁসছেন আরও কয়েকজন

নিজস্ব প্রতিবেদক
০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
আতঙ্কে রাজস্ব বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা

সরকারের পদস্থ দুই কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক ও কর বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে চরম আতঙ্ক। কখন, কার বিপুল বিত্তবৈভবের তথ্য গণমাধ্যমে চলে আসে, কার দিকে অনুসন্ধানী তীর ছুড়ে দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)Ñ এ নিয়ে তারা রীতিমতো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। নিজেদের রক্ষায় এখন তারা কর্মক্ষেত্রেই শুধু নয়, সর্বত্রই সর্বদা ভীষণ সাবধানে চলাফেরা করছেন। কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও আগেভাবে নানা হিসাব-নিকাশ করে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়। ব্যক্তিগত সেলফোনে দাপ্তরিক তো বটেই, ব্যক্তিগত কথোপকথনেও সাবধানতা অবলম্বন করছেন। নিজেদের বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার থেকেও বিরত থাকছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারেও তারা এখন যারপরনাই সংযত।

এদিকে দুদক সূত্রে জানা গেছে, শুধু মতিউর আর ফয়সালেই শেষ নয়, রাজস্ব বোর্ডের আয়কর ও শুল্ক বিভাগের আরও কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব নিতে উদ্যোগী হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী এই কমিশন। ইতোমধ্যে দুদকে রাজস্ব বোর্ডের দুই বিভাগের দুর্নীতিবাজ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে নামে-বেনামে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের পরই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। কিছু কিছু কর্মকর্তার সম্পদের ফিরিস্তি দেখে দুদক কর্মকর্তারা রীতিমতো বিস্মিত। দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদকের কমিশনার জহুরুল হক বলেছেন, পুলিশ, এনবিআরসহ সরকারের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। যে অভিযোগই আসুক, আমরা বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেব। কারও জন্য আমরা বিশেষ কিছু করছি না। কেউ আমাদের শত্রু বা মিত্র নন। সবার জন্যই সমান আইন, আইনানুগ আচরণ করা হবে।

জানা গেছে, এনবিআরের অধীন আয়কর ও শুল্ক বিভাগে কিছু কিছু পদ খুবই লোভনীয়। সেসব পদে পদায়ন পেতে রীতিমতো লড়াই চলে দুই বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। শুল্ক বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম ও ঢাকা কাস্টমস, বেনাপোল শুল্ক স্টেশন, কমলাপুর আইসিডি, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর, বৃহৎ করদাতা ইউনিটসহ আরও বেশ কয়েকটি স্থানে বদলি হতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুমুল প্রতিযোগিতা চলে। এর কারণ হিসেবে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এসব জায়গায় দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্ত অর্জন করা সম্ভব। এ কারণে ‘লোভনীয়’ এসব জায়গায় পদায়ন পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়; অনেককে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে এনবিআরের তিন কর্মকর্তার দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে ছাগলকা-ের পর মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসে। সামনে আসে কর ক্যাডারের কর্মকর্তা ও এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের অবৈধ সম্পদের তথ্য। এ ছাড়া বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কমিশনার হিসেবে অবসরে অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর দুর্নীতির বিষয়টিও সামনে আসে। চারটি মোবাইল কোম্পানিকে প্রায় ১৫৩ কোটি টাকা সুদ ছাড়ের দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের প্রেক্ষিতে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া মতিউর রহমানের দেশত্যাগেও আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তার বিরুদ্ধে আইনবহির্ভূতভাবে একক নির্বাহী সিদ্ধান্তে ১৬টি নথিতে ১৫২ কোটি ৮৯ হাজার ৩৯০ টাকা অপরিশোধিত সুদ মওকুফ করে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

ফয়সালের শাস্তি বদলি দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার অভিযোগ ওঠা এনবিআর কর ক্যাডারের কর্মকর্তা ও প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালকে গতকাল বগুড়া কর অঞ্চলের পরিদর্শী রেঞ্জ-১-এ বদলি করা হয়েছে। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে বগুড়া কর অঞ্চলের পরিদর্শী রেঞ্জ-১-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানকে। তবে আবু ফয়সালকে বগুড়ায় বদলি ইস্যুতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন খোদ এনবিআর কর্মকর্তারাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছেন, দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার পরও এমন ‘শাস্তি’ দিয়ে অসৎ কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করা হয়েছে। বদলি না করে সাময়িক বহিষ্কার করা যেত।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গতকাল নির্ধারিত সময়ে অফিসে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ফয়সাল অফিস করেননি। তিনি গতকাল নৈমিত্তিক ছুটিতে ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

দুর্নীতির মাধ্যমে ফয়সালের বিপুল ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সার মালিক হওয়ার খবর কয়েক দিন ধরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে আসছে। দুদকের অনুসন্ধানে তার এই বিপুল অর্থবিত্তের খবর প্রকাশ পায়। একজন মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা হয়েও কীভাবে এত ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন, এ নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটেই আবু মাহমুদ ফয়সালকে নিজ পদ থেকে সরানো হয়েছে, বলছে এনবিআর সূত্র।