এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জে পোশাক খাত

আব্দুল্লাহ কাফি
২৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জে পোশাক খাত


২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর সর্বাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প। জিএসপি বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধাসহ অন্যান্য বাণিজ্য সুবিধা যাবে কমে। একই সঙ্গে বেড়ে যাবে শ্রমিকদের মজুরি; বাড়বে উৎপাদন খরচ। ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও আমদানিকারকরা বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলক কম খরচে পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়বে। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, এ সংকট আরও বাড়বে পোশাকশিল্পের কিছু মালিকের কমপ্লায়েন্স পুরোপুরি না-মানার প্রবনতার কারণে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোশাক খাতে ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কর্মরত। তাদের ৬০ শতাংশই নারী। আগে থেকেই সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ না নিলে এ শিল্প খাতের পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

খাত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বলছেন, এলডিসি উত্তরণের পর জিএসপি সুবিধা বাতিল হলে তৈরি পোশাক খাতের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিসহায়তা অব্যাহত থাকলে তবেই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। তারা বলছেন, চলমান সব ইনসেনটিভ আগামী ২০২৯ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প ইনসেনটিভ প্রবর্তন না করা পর্যন্ত ইনসেনটিভগুলো কমানো যাবে না। তাহলে উদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেছেন, ভূরাজনৈতিক সংকটের প্রভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর বড় প্রভাব পড়েছে পোশাকশিল্পে। উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তাদের পোশাকের চাহিদা ও পোশাকের ওপর ব্যয় কমেছে। এর বিপরীতে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়পর্যায়ে সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে শিল্পের ব্যয় বহু গুণ বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে শিল্পকে টেকসই করতে ও রপ্তানির প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে নীতি সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।

বিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে ২০২৬ সালের পর থেকে বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধা আর থাকবে না। অন্তত ওই পর্যন্ত আমরা যদি বিভিন্ন নীতি সহায়তার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি, সেটি হবে আমাদের জন্য সময়োপযোগী কৌশল।

পোশাক খাতের আরেক উদ্যোক্তা বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ নিয়ে পোশাকশিল্পের মালিকরা মোটেও উদ্বিগ্ন নন। এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এরই মধ্যে বিজিএমইএ কাজ শুরু করেছে সরকার ও ক্রেতা দেশগুলোর সঙ্গে। দক্ষতা উন্নয়ন, বিনিয়োগ বাড়ানো, পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধাহীন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের টিকে থাকা নিয়ে আপাতত কোনো সংশয় দেখা যাচ্ছে না।

ফারুক হাসান আরও বলেন, ২০২৬ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারের সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ২০২৬ সালের পর বাড়তি যে তিন বছর শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধায় রপ্তানির সুযোগ দেবে, আলোচনার মাধ্যমে তা বাড়ানো যেতে পারে। বিজিএমইএ ইইউর কাছে ১০ বছরের জন্য এই সুবিধা চেয়েছে। এরপরে বিজিএমইএ ইইউর

সঙ্গে জিএসপি প্লাস নিয়ে আলোচনা করবে। তবে পোশাক মালিকরা চান, এ সময়ের মধ্যেই সরকার অন্যান্য দেশের সঙ্গে মুক্ত ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের পোশাক খাত শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণেই আজ সুদৃঢ় অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর পোশাক খাতই সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে এবং চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এলডিসি থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতিতে সার্বিক পরিবেশ উন্নতের পাশাপাশি অবকাঠামো ও মানবসম্পদ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে। এতে আনুমানিক সাত বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের (এপিও) ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকের গড় উৎপাদনশীলতা এক কম্বোডিয়া ছাড়া অন্য সব প্রতিযোগী দেশের চেয়ে কম।

সংস্থাটির তথ্যমতে, বাংলাদেশি শ্রমিকের মাথাপিছু বার্ষিক উৎপাদনশীলতার মাত্রা ১০ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার। যেখানে ভিয়েতনামের ১২ হাজার ৭০০ ডলার, ভারতের ১৫ হাজার ৮০০ ডলার এবং চীনের ২৩ হাজার ৮০০ ডলার। অর্থাৎ পোশাকণ ঘটলে অনেক দেশে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।