বেনজীরের বিরুদ্ধে মামলার দিকে এগোচ্ছে দুদক
মাঠপর্যায়ের কাজ শেষ চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ ।। পরিবারের পাঠানো লিখিত ব্যাখ্যা আমলে নেবে না ।। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে গুলশানের ফ্ল্যাটে যাবে দুদক
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ বিত্তবৈভব অর্জনের অপরাধে মামলা করার পথে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে মাঠপর্যায়ের কাজ। এখন চলছে প্রাপ্ত তথ্যাদির চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ। এর পরই মামলার জন্য সুপারিশ করা হবে।
বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের সন্ধান ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে, সেগুলো জব্দ করেছে দুদক; অবরুদ্ধ করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও কোম্পানির শেয়ার। গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে এসব সম্পদের অস্তিত্ব পায় দুদকের অনুসন্ধান টিম। এসব সম্পদের বিষয়ে দুদক প্রধান কার্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানকে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য তলব করা হলেও তারা কেউই হাজির হননি। তলবের বিপরীতে বেনজীর ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত ব্যাখ্যা পাঠানো হয়েছে দুদকে। এসব ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বৈধভাবেই তারা এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন। কিন্তু এ ব্যাখ্যা আমলে নিচ্ছে না দুদক। এ অবস্থায় সম্পদসংক্রান্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের বিচার-বিশ্লেষণ করে শিগগিরই কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করতে যাচ্ছে অনুসন্ধান টিম।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, কমিশনে প্রতিবেদন দাখিলের লক্ষ্যে দিন-রাত কাজ করছে অনুসন্ধান টিম। তবে এ পর্যায়ে বেনজীর আহমেদের কাছ থেকে সম্পদের হিসাব বিবরণী চাওয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে কমিশনের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা। যদি তার কাছ থেকে সম্পদ বিবরণী চাওয়া না হয়, তা হলে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেনজীর, তার স্ত্রী জীসান মির্জা এবং দুই মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসীন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে মামলার সুপারিশ করা হতে পারে।
দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এ পর্যন্ত বেনজীর পরিবারের নামে অবৈধ সম্পদসংক্রান্ত যেসব তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে, তাতে মামলা হওয়ার মতো সব
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
উপাদান রয়েছে। কিন্তু মামলা করতে গিয়ে যেন কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি না হয়, সে জন্য সবকিছুর চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। আশা করা হচ্ছে, কমিশনে শিগগিরই এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে।
সুপ্রিমকোর্টে দায়িত্বরত দুদকের সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান গতকাল বুধবার আমাদের সময়কে বলেন, গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে উচ্চ আদালত থেকে আমাদের দুই মাসের মধ্যে এ অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই মোতাবেক প্রতিবেদন দাখিলের সময় আরও কিছুদিন বাকি আছে। আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়েই আদালতে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে।
গুলশান ফ্ল্যাটে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে যাবে দুদক
দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট থেকে জানা যায়, বেনজীর আহমেদের গুলশানের চার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে আদালতে আবেদন করবে দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ। আদালতের আদেশ নিয়ে ফ্ল্যাটগুলোর ভেতরে যেসব জিনিসপত্র রয়েছে, সেগুলোর তালিকা তৈরি করা হবে।
বেনজীরের বিপুল পরিমাণ সম্পদের মধ্যে গুলশানে যে চারটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলো দেখভালের জন্য দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে রিসিভার নিয়োগ করা হয়। ওই চার ফ্ল্যাট একত্রিত করে সপরিবারে বসবাস করতেন বেনজীর। তারা দেশের বাইরে অবস্থান করায় ফ্ল্যাটগুলো তালাবদ্ধ রয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ফ্ল্যাটে যাবে দুদকের সম্পদ ইউনিটের কর্মকর্তারা। এরপর বাসায় থাকা সব জিনিসপত্রের তালিকা করে সেগুলো পরবর্তীতে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়, সে বিষয়ে আদালতের দিকনির্দেশনা চাওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ মার্চ ও ৩ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যরা অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। এরপর গত ১৮ এপ্রিল এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এরই ধারাবাহিকতায় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনজীরকে গত ৬ ও ২৩ জুন দুই দফা তলব করা হলেও তিনি আসেননি। তার স্ত্রী জীশান মীর্জা ও দুই মেয়ে ফারহীন ও তাহসীনও তলবে হাজির হননি। তারা গত ২২ জুন আইনজীবীর মাধ্যমে দুদকে লিখিত বক্তব্য পাঠান। এতে তাদের সম্পদ বৈধভাবে উপার্জিত বলে দাবি করা হয়। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের পাঠানো ব্যাখ্যা আমলযোগ্য নয়।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা ও তিন মেয়ের নামে ২০৫টি দলিলে ৭০২ বিঘা জমি (৩৩ শতকে এক বিঘা হিসাবে), ৩৩টি ব্যাংক হিসাব ও ২৫টি কোম্পানিতে বিনিয়োগ রয়েছে বলে সন্ধান পায় দুদক। এরপর গত ২৩ ও ২৬ মে এবং ১২ জুন আদালতের নির্দেশে এসব সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এসব সম্পত্তি গড়েছেন তিনি। দুদকের উপ-পরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম এ অনুসন্ধান করছে। টিমের অপর দুই সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী এবং মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন।
প্রসঙ্গত, বেনজীর আহমেদ ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যান তিনি।