ক্যাম্পের প্রাচীরে বন্দি রোহিঙ্গা শিশুদের স্বপ্ন

সৈয়দ রিফাত, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে ফিরে
২২ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ক্যাম্পের প্রাচীরে বন্দি রোহিঙ্গা শিশুদের স্বপ্ন

মাটিতে পড়ে থাকা ছোট্ট একটি মার্বেলের দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ৪-এর শিশু ফয়সাল (১০)। এরপর কায়দা করে হাতের আঙুলের ফাঁকে আরেকটি মার্বেল ধরে অপর হাতের আঙুলের সাহায্যে ছুড়ে দেয় সেটি। মুহূর্তেই মাটিতে থাকা মার্বেলটিকে আঘাত করে ছুড়ে দেওয়া মার্বেলটি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে সে। এমন আনন্দের মাঝেই তার মুখে ঘোর অমানিশার ছায়া পড়ে যখন সে ক্যাম্পের সীমানা প্রচীরের সামনে যায়। ফয়সাল শুধু জানে, প্রাচীরের বাইরে বের হওয়া তাদের জন্য নিষেধ। তার স্বাধীনতার স্বপ্ন মুহূর্তেই থেমে যায় এই খাঁচার কাছে এলে। ফয়সালের মতো ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশুর শৈশবের স্বপ্ন বন্দি হয়ে আছে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সীমানা প্রাচীরে। 

বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আশ্রয়শিবিরগুলোতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৩০৬ জন। এর মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। তাদের বয়স শূন্য থেকে ১৭ বছর। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা বাবা-মায়ের মতোই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আশ্রয়শিবিরগুলোতে কাটছে এমন লাখ লাখ শিশুর শৈশব। এদের অনেকেরই দিন কাটছে মানসিক টানাপড়নে। হতাশা-ক্ষোভ থেকে অনেকে জড়িয়ে পড়ছে মাদক পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।

সম্প্রতি উখিয়ার কয়েকটি ক্যাম্প এবং সেখানে বসবাস করা শিশু ও তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্যাতন থেকে বাঁচতে নিজ ভূমি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় পেলেও এখানেও বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাদের একপ্রকার যুদ্ধ করতে হয়। বেশির ভাগ শিশুই জানে না কবে তাদের মুক্তি মিলবে। চোখে স্বপ্ন থাকলেও অধরা। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি এবং বন্দি দশার কারণে বেশির ভাগ শিশুই মানসিক হতাশায় আক্রান্ত। ১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের বেড়ার ঘরে বাস করা এসব শিশুর মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হচ্ছে না। 

উখিয়ার ক্যাম্প ৪-এ কথা হয় ১৬ বছর বয়সী সলিমুল্লাহর সঙ্গে। ক্যাম্পের লার্নিং সেন্টারগুলোতে যাতায়াতের কারণে শিক্ষকতা পেশা তাকে আকৃষ্ট করেছে। পড়ালেখা শেষে সুযোগ পেলে মালয়েশিয়ায় গিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চায় সে। তার এই ইচ্ছা কবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। 

ভয় আর আতঙ্কের কালো ছায়া শিশুদের ওপর : অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সঙ্গে ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের শিশুরা। বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের জন্য দিনকে দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে ক্যাম্পগুলো। উখিয়ার ক্যাম্প ৮-এ বসবাসকারী সাকিবা জানান, প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খুন, অপহরণের খবর পান। তাই সন্তানদের সহজে চোখের আড়াল হতে দেন না। এই আতঙ্ক সন্তানদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, ‘বার্মার মতো ডর নাই, কিন্তু এখানে অন্য ডর আছে।’ ক্যাম্প ৪-এর রোকেয়া বেগম বলেন, ‘সন্তানরা বড় হচ্ছে, তাদের নিরাপদে রাখা নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকি।’ ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করা কর্মীদের তথ্য বলছে, বসবাসকারী ৬০ শতাংশ রোহিঙ্গাই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। 

অপুষ্টির শিকার রোহিঙ্গা শিশুরা : ক্যাম্পে থাকা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার জীবন ধারণ নির্ভর করছে মানবিক সহায়তার ওপর। দাতা সংস্থা থেকে মাসিক ১০ ডলার সহায়তায় পরিবারসহ তাদের তিনবেলার খাবার হয় না বলে জানান তারা। বিশেষ করে বাচ্চাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে যুদ্ধ করতে হয় তাদের। গত বছর দাতা সংস্থাগুলো রেশনের পরিমাণ হঠাৎ কমিয়ে দিলে ক্যাম্পের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবারকে খাদ্যের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে করা একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ বলছে, মোট শিশুর ১৫ শতাংশই চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। অন্যদিকে শিশুদের জন্য ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে পুষ্টিসমৃদ্ধ বিশেষায়িত খাবার দেওয়া হলেও অভিভাবকরা সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে পুষ্টিবঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা।

বাল্যবিয়ের শিকার কন্যাশিশুরা : ক্যাম্পগুলোতে বাল্যবিয়ে নৈমিত্তিক ঘটনা। রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পে অপরাধ ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে কন্যাশিশুদের নিয়ে আতঙ্কে থাকেন তারা। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিয়েকেই বিকল্প হিসেবে দেখেন তারা। আবার পরিবারের আর্থিক অনটন থেকেও মুক্তি মেলে মেয়েকে স্থানান্তরিত করতে পারলে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মাথাপিছু যে পরিমাণ সাহায্য পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। এ ছাড়া কন্যাশিশুদের বিষয়ে বেশকিছু কুসংস্কারও আছে রোহিঙ্গাদের মাঝে। তবে এ ধরনের বিয়ে সাধারণত ক্যাম্পে কর্মরত সংশ্লিষ্টদের চোখ এড়িয়ে গোপনেই সম্পন্ন হয়।

নিজ দেশে ফিরতে চায় শিশুরা : ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে ৩৬ শতাংশই ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী। এসব শিশু জানে, এই ক্যাম্প প্রকৃতঅর্থে তাদের না। নিজ ভূমি থেকে তারা জোরপূর্বক বিতাড়িত। যুদ্ধ তাদের বাধ্য করেছে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে। ক্যাম্পের শিশুরা জানায়, তারা নিজের দেশে ফিরতে চায়। ৮ বছর বয়সী জাফর জানায়, সে কখনো মিয়ানমার দেখেনি। মায়ের কাছে, নানি ও দাদির গল্প শুনেছে। তাদের দেখতে মন চায়। ফিরে যেতে ইচ্ছা করে নিজের দেশে। 

কবে নাগাদ এসব শিশু নিজ দেশে ফিরতে পারবে, এমন প্রশ্নের জবাবে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মিজানুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে প্রত্যাবাসন বন্ধ আছে। তবে সরকার এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করছে।