সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় বকেয়ার পাহাড়
দেশের বিভিন্ন সরকারি কোম্পানি এবং স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত ও স্থানীয় সরকার সংস্থার কাছে সরকারের বকেয়ার পাহাড় জমেছে। নানা ধরনের উদ্যোগের পরও বকেয়া কমেনি, উল্টো বেড়েছে। এমন ১৪২ সংস্থার কাছে সরকারের বকেয়া ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে আসল টাকা ৭৮ হাজার ১৭৭ কোটি এবং সুদ ১ লাখ ১৬ হাজার ৩১৯ কোটি, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে গত বছর থেকেই সতর্ক অবস্থান নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে গত বছরের এপ্রিল মাসে এক পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, পাবলিক সেক্টর করপোরেশন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে এখন থেকে আর কোনো ইকুইটি বা মূলধন দেবে না সরকার। অর্থের প্রয়োজন পড়লে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ অর্থ ঋণ হিসেবেই দেওয়া হবে। তবে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনো সংস্থাকে মূলধন দেওয়ার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের জারি করা পরিপত্রে এসব বিষয় জানানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ, মূলধন ও অনুদান দিয়ে থাকে সরকার। উন্নয়নমূলক ও অনুন্নয়নমূলক দুই ধরনের খাতেই শর্তসাপেক্ষে অর্থ দেওয়া হয়। তবে অনেক সংস্থাই এ ক্ষেত্রে শর্ত পূরণ করতে পারে না।
রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সরকার সংস্থাগুলোকে এই ঋণ ও মূলধন সরবরাহ করে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও এটি করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুদসহ তা ফেরত দেওয়ার শর্তে ঋণের অর্থ দেওয়া হয়। আর লভ্যাংশ দেওয়ার শর্তে দেওয়া হয়ে থাকে মূলধন।
জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি পাওনা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি লিমিটেড। এ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় ৩০ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ৬৫ হাজার ৮৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। খবর অর্থনৈতিক সমীক্ষা সূত্রের।
আরও পড়ুন:
আকতার পারভেজ সর্বোচ্চ ভোটে সিএসই পরিচালক
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রয়োজনের অধিক জনবল এবং ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বাড়ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দক্ষতা বাড়াতে এসব প্রতিষ্ঠানে সংস্কার জরুরি।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, অতীতেও আমরা এ রকম দেখেছি। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। পাশাপাশি সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে।
জানা গেছে, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের পাওনা মোট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বকেয়া এই টাকা দিয়ে ছয়টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। আগের বছরের একই সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় এই বকেয়া ১১ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। কোনো কোনো সংস্থা দীর্ঘদিন থেকে এসব অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে প্রতিবছরই বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ ও সুদ-আসল মিলে প্রতিষ্ঠানটির কাছে বকেয়ার পরিমাণ ৭৬ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে বকেয়া ১৯ হাজার ৯০২ কোটি টাকা এবং তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাওয়ার গ্রিডের কাছে পাওনা ১৪ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। তাদের বিভিন্ন ঋণের বিপরীতে যেসব গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ সেবার অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। দেশে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের প্রচুর অর্থ ঋণ হিসেবে জোগান দিতে হয়েছে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের কাছে ১৩ হাজার ৯৪৬ কোটি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কাছে ৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ২ হাজার ৮৭৯ কোটি, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি ২৫৯ কোটি, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) ৭৫০ কোটি, ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৯৬ কোটি, চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের কাছে ৮ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা, টিসিবির কাছে ৭ হাজার ৪৪৬ কোটি, বিপিসির কাছে ৪ হাজার ৪৮২ কোটি, বিআইডব্লিউটিসির কাছে ৪ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তম হিমশৈল
এ ছাড়াও যাদের বেশি বকেয়া রয়েছে এগুলো হলো- বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন, বাংলাদেশ ইস্পাত প্রকৌশল কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার সাপ্লাই, নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন, কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থা, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ঢাকা সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম ওয়াসা, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড এবং খুলনা ওয়াসা।
এসব সংস্থার কাছে সরকারের বকেয়া দীর্ঘদিনের। ইতোমধ্যে মোট টাকার বড় অংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। একক বিভাগ হিসাবে সবচেয়ে বেশি টাকা রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে। বকেয়ার এই তালিকায় দেশের ৫৫টি পৌরসভাও রয়েছে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় ৩০ প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬৫ হাজার ৮৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৯ হাজার ৭৩০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১৮৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
খেলাপি ঋণ রয়েছে বিজেএমসি, বিএডিসি, বিটিএমসির মিলে ১৭৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ১৭ প্রতিষ্ঠানে ৭ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ এক হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম