দাম কিছুটা বাড়লেও হতাশ ব্যবসায়ীরা

আব্দুল্লাহ কাফি
২০ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
দাম কিছুটা বাড়লেও হতাশ ব্যবসায়ীরা

বেশ কয়েক বছর পর এবার কোরবানির গরুর কাঁচা চামড়ার দাম পিসপ্রতি ৫০-১০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হলেও ছাগলের চামড়ায় দাম নেই বললেই চলে। ছাগলের চামড়া কোথাও গরুর চামড়ার সঙ্গে ফ্রি দিয়ে দিতে হয়েছে, কোথাওবা আবদার অনুরোধের কারণে আড়তদাররা প্রিসপ্রতি ১০-১৫ টাকা করে দিয়েছেন। এমনই চিত্র ছিল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন

অঞ্চলে। তদুপরি সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে গরুর চামড়া বিক্রি করতে পারেননি বলে অভিযোগ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের। পথে পথে চাঁদাবাজির কারণেও ভুগতে হয়েছে, বলছেন তারা।

ঈদের দিন দুপুর থেকেই ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে পশুর চামড়াবোঝাই ট্রাক প্রবেশ করতে দেখা গেছে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে ও লালবাগের পোস্তায়। কেউ আবার বিক্রি করেছেন সাভারের আমিনবাজারে। কিন্তু চামড়ার প্রত্যাশিত দাম না পেয়ে তারা হতাশ।

এদিকে পাঁচ বছর পর এবার চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় রাস্তায় ফের চামড়া পড়ে থাকতে দেখা গেছে। জানা গেছে, মৌসুমি সংগ্রহকারী ও খুচরা বিক্রেতারা এগুলো ফেলে গেছেন। তাদের অভিযোগ, আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে তারা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি এবং লোকসান দিতে হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নষ্ট হয়ে যাওয়া দশ সহস্রাধিক চামড়া রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে ভাগাড়ে ফেলেছেন।

পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ কোরবানিদাতার নিকটতম দরিদ্র-অসহায় আত্মীয়-স্বজনের হওয়ায় আগের ঈদগুলোতে দেখা যেত, এতিমখানা-মাদ্রাসার লোকজন বাজার মূল্যের চেয়ে কিছুটা কম দাম দিয়ে চামড়া কিনে নিতেন। কিন্তু চামড়ার দাম কম হওয়ায় এতিমখানা-মাদ্রাসাগুলো এখন বিনামূল্যে নিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানও ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারছে না। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে দরিদ্র-অসহায় মানুষজন। অন্যদিকে কাঁচা চামড়ার দাম কম হওয়ায় এখন আর মৌসুমি ব্যবসায়ীর দেখা তেমন একটা মেলে না। আগের মতো এখন পাড়া-মহল্লায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ঘুরে ঘুরে কাঁচা চামড়া তেমন একটা সংগ্রহ করে না। সারা দিন পরিশ্রম করে, পুঁজি খাটিয়ে তাদের পোষায় না।

চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সনদ না থাকায় বিশ^বাজারে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না।

ক্রেতারা আন্তর্জাতিক মানের দর দেয় না।

চামড়ার আড়তদার ও ট্যানারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের ঈদে এক কোটিরও বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। এবার লবণের দাম কিছুটা কমলেও শ্রমিকের মজুরি ও গাড়ি ভাড়া বেড়েছে। তদুপরি কিছু চামড়া নষ্ট থাকে। সব মিলিয়ে নির্ধারিত দরের চেয়ে কিছুটা কমে কাঁচা চামড়া কিনতে হয়, নয়তো পোষায় না।

গত ৩ জুন চামড়া খাতের একাধিক বাণিজ্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানির পশুর চামড়ার দর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫-৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২০-২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

সাধারণত বড় আকারের গরুর চামড়া ৩১-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর ২১-৩০ বর্গফুট এবং ছোট আকারের চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর (২৫ বর্গফুট) লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১৩৭৫-১৫০০ টাকা। এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাবদ গড়ে ৩০০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১০৭৫-১২০০ টাকা।

লবণযুক্ত চামড়ার সঙ্গে সমন্বয় করেই এবারের কাঁচা চামড়া কিনেছেন এমন দাবি করেছেন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সাধারণ সম্পাদক মো. টিপু সুলতান। গতকাল বুধবার তিনি আমাদের সময়কে বলেন, নানা সংকটের মাঝেও এবার পোস্তার আড়তদাররা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছে। কাঁচা চামড়ায় প্রসেসিং, লেবার, লবণ মেশানোসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতি পিস কাঁচা চামড়ায় খরচ পড়ে ৩০০ টাকার বেশি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার ভৌমিক বলেন, সাভারের ট্যানারিগুলোতে ৬ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য ছিল। এখন পর্যন্ত ৪ লাখের বেশি চামড়া এসেছে। আরও চামড়া আসছে। ব্যবস্থাপনা উন্নত হওয়ায় কোনো আড়তে অরাজকতা হয়নি।

কিছুদিন পরই লবণজাত চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শুরু হবে হেমায়েতপুরের শিল্পনগরীতে। অনেক প্রতিষ্ঠানই কমপ্লায়েন্সে এগোচ্ছে, বলছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ। শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা জানান, আগের চেয়ে মান অনেকটাই ভালো অবস্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের। তিনি বলেন, এবার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর কমন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত ও কার্যকর করা হয়েছে। সব মডিউলকে ওভারহোলিং তথা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মেরামতপূর্বক ঢেলে সাজানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দিয়ে তরল বর্জ্যকে পরিশোধন করা হয়েছে। তা ছাড়া বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রাথমিক পরিশোধন ছাড়া যাতে কোনো ট্যানারির বর্জ্য সিইটিপিতে আসতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে নতুন আরেকটি সিইটিপি নির্মাণের মাধ্যমে বছরব্যাপী চামড়া প্রক্রিয়ার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তগুলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যতম বড় জায়গা। সেখানে কোরবানির প্রথম দিন অর্থাৎ গত সোমবার বিকালে বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বড় ও মাঝারি আকারের চামড়া ৭০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

রাজধানীর তেজগাঁও বেগুনবাড়ী আহসানুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার মুহতামিম হাফেজ ফরহাদ হোসেন আমাদের সময়কে জানান, গতবারের চেয়ে এবার চামড়ার দাম একটু বাড়তি। তবে সেই বাড়তি দাম পাওয়া যায় যদি দুপুরের মধ্যে চামড়া পোস্তায় পৌঁছানো যায়। তিনি জানান, চামড়ার দাম না থাকায় তার প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের দিয়ে আর চামড়া সংগ্রহ করান না। তিনি নিজেই কিছু চামড়া সংগ্রহ করেন ফ্রিতে। কারণ টাকা দিয়ে কিনে গাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য খরচের পর আর তেমন কিছু থাকে না। তাই তিনি ফ্রিতে যে কটি পাওয়া যায়, তা-ই বিক্রি করেন। এবার তিনি ৫০টি চামড়া সংগ্রহ করে সাইন্সল্যাবের সামনে বিক্রি করেছেন ৮০০ টাকা দরে। গতবার একই ধরনের চামড়া তিনি বিক্রি করেছেন ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে।

যাত্রাবাড়ী এলাকার সবচেয়ে বড় বেসরকারি কওমি মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া। এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারী রয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর কোরবানির ঈদে যে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করে, তা বিক্রি করে অন্তত চার মাস প্রতিষ্ঠানের ব্যয় মেটাতে পারত। এখন দাম না থাকায় ১৫ দিনের ব্যয়ও মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।

মিরপুরের একটি মাদ্রাসা থেকে সাড়ে ৬০০ চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারি পল্লীতে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির এমডি মো. সাখাওয়াতের মালিকানাধীন কারখানায় নিয়ে যান বেশ কিছু আলেম। দাম নিয়ে আক্ষেপ করে একজন হাফেজ বলেন, দানের এসব চামড়া দিয়েই তাদের মাদ্রাসা ও এতিমখানা চলে। সরকার নির্ধারিত দাম তো দূরের কথা, ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করে প্রতিটি গরুর চামড়ার মূল্য দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকার কদমতলী, লালবাগের পোস্তা ও সাভারের আমিনবাজার ঘুরে চামড়া শিল্পনগরীতে পিকআপবাহী চামড়া নিয়ে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ী কেরামত উল্লাহ জানান, আমিনবাজার এলাকায় লাঠিসোটা হাতে নিয়ে একদল লোক আমিনবাজারে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। অন্যথায় চামড়াপ্রতি ২০ টাকা করে দাবি করেন। শেষে চামড়াপ্রতি চাঁদা দিয়ে তাদের সেখান থেকে আসতে হয়েছে।

পোস্তার আড়তদাররা জানান, বড় গরুর চামড়া প্রতিটি ৮০০-৯০০ টাকা, মাঝারি ৬০০-৭০০ টাকা এবং ছোট গরুর চামড়া ২০০-৩০০ টাকায় কিনেছেন। আর ছাগলের চামড়া কেউ কেউ ফ্রিতে দিয়েছেন। আবার কেউ ১০ টাকা করে নিয়েছেন।

এদিকে আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ। গতকাল বুধবার ধানমন্ডিতে কোরবানির চামড়া সঠিকভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহন বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

শাহীন আহমেদ আরও বলেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর ও করোনা মহামারীসহ বৈশ্বিক নানা সংকটে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের চামড়া খাতে। মূলত এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় দেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতি হচ্ছে না। আর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় আন্তর্জাতিক সনদ অর্জনও সম্ভব হচ্ছে না।

এবার সারাদেশে ৮০ লাখ পিস চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে জানিয়ে শাহীন আহমেদ বলেন, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। তবে অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়া করায় তিন দিনে কয়েক লাখ পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, চামড়ার গুণগত মান নির্ভর করে যথাযথভাবে চামড়া ছাড়ানো, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ওপর। প্রাণীর শরীর থেকে সঠিকভাবে চামড়া ছাড়ানো এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণ না হওয়ায় চামড়ার গুণগত মান অক্ষুণ্ন থাকে না। এ জন্য অনভিজ্ঞতা ও অসচেতনতাই দায়ী।

ছাগল ও খাসির চামড়া অনেক বেশি নষ্ট হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাগলের চামড়া সংরক্ষণ করতে হাজার টাকা খরচ হয়। সে জন্য ঝুঁকি নিতে চান না ব্যবসায়ীরা। অসাবধানতাবশত চামড়া ছাড়াতে গিয়ে অন্তত ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে।

পাচাররোধে যশোর সীমান্তে বিজিবির সতর্কতা : ভারতে চামড়া পাচার রোধে ঈদের দিন থেকে টানা ১০ দিন বাড়তি সতর্কতা জারি করেছে বিজিবি। ইতোমধ্যে সীমান্তে বাড়ানো হয়েছে বিজিবির টহল। সীমান্তঘেঁষা ২১ ব্যাটালিয়ন বিজিবিকেও সতর্ক থাকতে দেখা গেছে। বিজিবির পাশাপাশি পুলিশের নজরদারিও রয়েছে। এতকিছুর পরও দেশে চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পাচারের শঙ্কা থেকেই যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সাভার প্রতিনিধি, বেনাপোল (যশোর) সংবাদদাতা, নওগাঁ প্রতিনিধি ও পঞ্চগড় প্রতিনিধি এবং চট্টগ্রাম ব্যুরো