করনির্ভর বাজেটে নিম্নআয়ের মানুষের চাপ আরও বাড়বে

আবু আলী
১৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
করনির্ভর বাজেটে নিম্নআয়ের মানুষের চাপ আরও বাড়বে

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী নানা খাতে কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। বিশেষ করে আমদানিকৃত ও দেশে উৎপাদিত কিছু পণ্য এবং সেবার ওপর বিভিন্ন ধরনের কর ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ফলে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর।

মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মেনে কর-জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাত বাড়াতেই এমন উদ্যোগ নিয়েছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। যদিও রাজস্ব আহরণ বাড়াতে নতুন কোনো সংস্কারের দিশা দেননি তিনি। বরং নিয়মিত করদাতাদের থেকেই বাড়তি কর আদায়ে মনোযোগ দিয়েছেন বেশি।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে মূল্য সংযোজন করে (ভ্যাট) অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর মানে এর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে। অথচ আয়করে কোনো ছাড় পাচ্ছেন না তারা।

অন্যদিকে আইএমএফের কর ছাড় কমিয়ে আনার শর্ত মানতে গিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় শিল্প ও বিনিয়োগকে চাপে ফেলা হয়েছে। হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে এক শতাংশ শুল্ক আরোপে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এদিকে আমদানি বিকল্প দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পে উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ও কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক হার বাড়ানো হয়েছে। এতে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শিল্প কারখানা স্থাপনের প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং স্ট্রাকচার। প্রস্তাবিত বাজেটে এ ধরনের স্থাপনার আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে শিল্প স্থাপনের শুরুতেই খরচ বাড়বে উদ্যোক্তাদের। এরপর বাজেটে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্ল্য­ান্ট, ইকুইপমেন্ট ও ইরেকশন ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে। বাড়বে দাম। এ ছাড়া শিল্পের উৎপাদন পর্যায়েও ভ্যাট হার বাড়ানো হয়েছে।

রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশীয় শিল্প বিকাশের চলমান গতিশীলতা রাখতে এসি উৎপাদনে স্থানীয় পর্যায়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট এবং ফ্রিজ আমদানিতে ৫ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এতে দেশীয় শিল্পের গতিশীলতা ধরে রাখা কষ্টকর হবে। পাশাপাশি দেশ আবার আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। 

অন্যদিকে, বাজেটে এসি-ফ্রিজ তৈরির প্রধান কাঁচামাল কম্প্রেসারকে রেয়াতি সুবিধার প্রজ্ঞাপনে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কম্প্রেসার আমদানিতে ন্যূনতম মূল্য আরোপ করা হয়েছে। ফ্রিজের নন ইনভার্টার কম্প্রেসার ৪০ ডলার, ইনভার্টার ৬৫ ডলার, এসির নন ইনভার্টার কম্প্রেসার ৫০ ডলার ও ইনভার্টারের ন্যূনতম মূল্য ৮৫ ডলার করা হয়েছে। পাশাপাশি এয়ারকন্ডিশন উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিনিয়োগকে অর্থনৈতিক অঞ্চলমুখী করতে একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল-হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা করছে সরকার। সেই লক্ষ্যে কাজ করতে একাধিক বেসরকারি উদ্যোক্তা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য লাইসেন্স নিয়েছেন। কিন্তু বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চলে ডেভেলপারের ব্যবহƒত সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক বসানো হয়েছে। এ ছাড়াও শিল্প স্থাপনে এক শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

যদিও অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, নিত্যপণ্য সরবরাহে উৎসে আয়কর ২ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমানো হয়েছে। এতে খরচ কমতে পারে ১০০ টাকায় এক টাকা। এর সুফল পাবেন আমদানিকারকরা। অন্যদিকে আমদানি পর্যায়ে মার্কিন ডলারের দাম ১১৩ টাকা ধরে শুল্কায়ন শুরু হয়েছে। এতে নিত্যপণ্যসহ সব পণ্য থেকে বাড়তি কর পেতে শুরু করেছে সরকার। আগামী মাসে ডলারের দাম আরও বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১৭ টাকার বেশি।

বাজেটে শুল্ক কমানোর তালিকায় উল্লেখযোগ্য হলো গুঁড়া দুধ। এর দাম কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু ভোজ্যতেল, চিনি, জ্বালানি তেল ইত্যাদি পণ্যের শুল্ককর কমানোর কোনো ঘোষণা নেই। আলু, পেঁয়াজ, ডিম, মুরগির মাংস, গরুর মাংস, মাছ ইত্যাদির দাম কীভাবে কমবে, সে কথাও বাজেটে নেই।

একদিকে করের বোঝা, অন্যদিকে বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি তেলের বিলের বোঝা। আইএমএফের চাপে এসব পণ্যের দর বাড়িয়েই চলেছে সরকার। এবারের বাজেটে মুঠোফোনে কথা বলার বিলও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এমনকি বাড়বে মেট্রোরেলের ভাড়াও। ফলে চাপে থাকবে মানুষ। চাপ থেকে বের হওয়ার পথ একটাই, আয় বৃদ্ধি। ঢাকা ওয়াসা পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়িয়েছে, যা বাজেট কার্যকরের দিন ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়িত হবে। বিদ্যুতের দাম আগামী তিন বছর সমন্বয়ের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে সরকার, এতে কার্যত বিদ্যুৎ ও সংশ্লিষ্ট সবকিছুর দাম বাড়বে।