লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর আরাফাত ময়দান

পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতায় আজ পশু কোরবানি :: ফিলিস্তিনিদের জন্য দোয়া

আমাদের সময় ডেস্ক
১৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর আরাফাত ময়দান

বিশে^র লাখো মুসলিম গতকাল শনিবার সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সৌদি আরবের মক্কার আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন। এর মধ্য দিয়ে এ বছর সম্পন্ন হলো ইসলামের প্রধান পাঁচ স্তম্ভের একটি হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আরাফাতে অবস্থানই হলো হজ। এদিন আরাফাতের ময়দান ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্?দা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাক (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার)’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে। এদিকে আজ মিনায় পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহা উদযাপন করবেন হাজিরা। এ বছর বাংলাদেশ থেকে ৮০ হাজারের বেশি হজযাত্রী সৌদিতে হজ করতে গেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে এবার ২০ লাখ মুসলিমের সমাগম ঘটার কথা বলছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। সূত্র : সৌদি গেজেট, এএফপি ও আলজাজিরা। 

হজের আনুষ্ঠানিকতার কঠিন দিনে ক্রমবর্ধমান তীব্র তাপমাত্রার মধ্যে মক্কা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ৭০ মিটার (২৩০-ফুট) উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে আরাফাত ময়দানে হাজিরা তাসবি পাঠ, কোরআন তিলাওয়াত ও মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফের প্রার্থনা করেন। তারা পাহাড়ের চূড়া জাবালে রহমতে আরোহণ করেন। এখানেই প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁর বিদায় হজের শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। ইসলামের আলোয় আলোকিত হয়ে কীভাবে জীবনযাপন করতে হবে, সেসব দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এ কারণে হজ ছাড়াও আরাফাতের ময়দান মুসলিমদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। 

সৌদি আরবের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সরাসরি প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, হাজিরা জাবালে রহমত পাহাড়ে উঠেছেন। হজরত মোহাম্মদ (সা.) যেভাবে হজ করেছেন, এখনো ঠিক সেই একইভাবে হজ পালন করা হয়। যদিও আগে হজ পালন কষ্টকর হলেও এখন প্রযুক্তির সহায়তায় তা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে।

এদিন মক্কার তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়ায়, যা বিশেষ করে এই দিনের প্রার্থনা এবং কোরআন তেলাওয়াতের সময় বয়স্কদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। সৌদি কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই হজযাত্রীদের প্রচুর পানি পান করার এবং সূর্যের তাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করার আহ্বান জানায়। যেহেতু পুরুষদের টুপি পরা নিষিদ্ধ, তাই অনেকেই এ জন্য ছাতা বহন করেন।

ঘানার নাগরিক ২৬ বছর বয়সী আব্রামান হাওয়া বলেন, ‘হজ সম্পন্ন হতে কমপক্ষে পাঁচ দিন সময় লাগে এবং বেশিরভাগই বাইরে উন্মুক্ত স্থানে। এটি সহজ নয়। কারণ, এখানে খুব গরম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আরাফাতের ময়দানে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব, আমি আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করি।’

গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ইহরাম বাঁধা (সেলাইবিহীন সাদা কাপড়) লাখো হজযাত্রী যাত্রা শুরু করে শুক্রবার জোহরের আগে তাঁবুর শহরখ্যাত মিনায় পৌঁছেন। মিনায় ৮ জিলহজ জোহর থেকে পরদিন ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব এবং সেখানে অবস্থান করা সুন্নত। শনিবার ফজরের পর হাজিরা তালবিয়া (লাব্বাইক) পড়তে পড়তে মিনা থেকে আরাফাতের দিকে রওনা হন। জোহরের আগেই আরাফাতের ময়দানে গিয়ে উপস্থিত হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করেন তারা। সেখানে সমবেত হয়ে প্রার্থনা করা ও খুতবা শোনাকেই হজ ধরা হয়।

সৌদি আরবে শুক্রবার থেকে জিলহজ মাস গণনা শুরু হয়েছে। সেই অনুযায়ী ১৫ জুন আরাফাতের ময়দানে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা হয়। আজ সৌদিতে (১০ জিলহজ) কোরবানির মধ্য দিয়ে ঈদুল আজহা উদ্?যাপন করা হবে।

আরাফাতের ময়দানে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করে হজযাত্রীরা মুজদালিফায় যান; সেখানে এক আজানে আলাদা ইকামতে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন হাজিরা। মুজদালিফায় সারারাত খোলা আকাশের নিচে অবস্থানের পর ফজরের নামাজ আদায় করে সূর্য ওঠার কিছু আগে ফের মিনার উদ্দেশে রওনা দেবেন হাজিরা। এর আগে তারা শয়তানকে মারার জন্য পাথর সংগ্রহ করবেন।

১০ জিলহজ (রবিবার) সকালে মিনায় এসে বড় জামরাতে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয়। কঙ্কর নিক্ষেপের স্থানগুলোতে দেওয়া দিকনির্দেশনা মনোযোগ সহকারে শুনে তা সম্পন্ন করতে হবে জোহরের মধ্যে। বড় জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনায় কোরবানির পশু জবাই করতে হয়। কোরবানির পর পরই মাথা মুণ্ডন সেরে ফেলতে হয়। এর মাধ্যমে ইহরামের কাপড় পরিবর্তনসহ সব সাধারণ কাজ করা গেলেও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে।

হজের সর্বশেষ রোকন কাবাঘর তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ, যা ১১ জিলহজ (সোমবার) থেকে ১২ জিলহজ (মঙ্গলবার) সূর্য ডোবার আগেই সম্পন্ন করতে হবে। সূর্য ডোবার আগে সেটি করতে না পারলে দম বা কোরবানি কাফ্ফারা আদায় করতে হবে।

১১ ও ১২ জিলহজ মিনায় অবস্থান করে ধারাবাহিকভাবে ছোট, মধ্যম ও বড় জামারাতে ৭টি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে প্রতিদিন। যদি কেউ কঙ্কর নিক্ষেপের আগে কিংবা পরে কাবা শরিফ গিয়ে তাওয়াফ করেন, তবে তাকে তাওয়াফের পর আবার মিনায় চলে আসতে হবে এবং রাতে মিনায় অবস্থান করতে হবে। ১০ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত মিনায় রাত্রযাপন করতে হয়। কেউ মিনা ত্যাগ করতে চাইলে ১২ জিলহজ সূর্য ডোবার আগেই চলে যেতে হবে। এ সময়ের মধ্যে মিনা ত্যাগ করতে না পারলে ১৩ জিলহজ (বুধবার) মিনায় অবস্থান করতে হবে। সেদিন সাতটি করে আরও ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে।

দেশে রওয়ানা হওয়ার আগে তাওয়াফ করতে হয়, যাকে বিদায়ী তাওয়াফ বলে। তবে জিলহজ মাসের ১২ তারিখের পর যে কোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফ হিসেবে আদায় হয়ে যায়।

ফিলিস্তিনিদের জন্য বিশেষ দোয়া : হজের খুতবায় ফিলিস্তিনের, বিশেষ করে গাজার মুসলমানদের জন্য বিশেষভাবে দোয়ার আহ্বান জানান মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতিব শায়েখ মাহের আল মুয়াইকিলি। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের মুসলমানরা যুদ্ধের কবলে, তারা বিপর্যস্ত। তাদের খাওয়ার পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, পৃথিবীর সবধরনের আরাম ও সুখ থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের জন্য দোয়া করুন। বিশ্ব মুসলিমের কাছে এটা তাদের পাওনা।

ইমাম আরও বলেন, যারা ফিলিস্তিনিদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন, সহযোগিতার চেষ্টা, অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সহযোগিতা করছেন, তারাও দোয়ার হকদার। এ ছাড়াও যারা হজযাত্রীদের সেবা করছেন তারাও দোয়ার হকদার।

আল মুয়াইকিলি বলেন, ইবাদত শুধু আল্লাহর জন্য। যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করবে, তিনি এমন জায়গা থেকে রিজিক পাবেন, যেখান থেকে তিনি কল্পনাও করতে পারবেন না। তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর মালিক। তিনি আমাদের জন্য রহমত হিসেবে কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। কোরআন এমন একটি গ্রন্থ, যার প্রতিটি আয়াত প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ। এই কোরআন মানুষকে সরল পথ দেখায়।