মেয়াদ বাড়ছে তেলভিত্তিক ৬ রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের
অপেক্ষা ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের ।। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন মিলেছে
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না জ্বালানি সংকটে। সরকারি হিসাবে ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও গড়ে ১৫ হাজারের মধ্যেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তবু তেলভিত্তিক আরও ছয়টি ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে মেয়াদ আবারও বাড়ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রেগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অনুমোদন হয়ে এসেছে। এখন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সামনের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রস্তাব প্রেরণের প্রক্রিয়া চলছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত মাসে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ছয়টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবের একটি সারসংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ
মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন দিয়েছেন। তবে প্রস্তাবটি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে আগামী মাসে প্রেরণের সম্ভাবনা রয়েছে।
ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার লিমিটেডের মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট, ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেডের মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট, ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট ও খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট এবং একর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সার্ভিসেস লিমিটেডের জুলদা চট্রগ্রাম ১০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে মদনগঞ্জ কেন্দ্রের মেয়াদ গত ২২ মার্চ শেষ হয়েছে। মেঘনাঘাট, সিদ্ধিরগঞ্জ, নোয়াপাড়া ও খুলনা কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৩ মার্চ এবং জুলদা কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রসঙ্গত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা সরকারের কাছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পাবে। ডলার সংকট এবং আর্থিক সংকটে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বিল সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। নগদ টাকায় বিল পরিশোধ করতে না পেরে ঋণের পরিবর্ততে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক মালিককে বন্ড ইস্যু করেছে। যদিও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা বন্ড ইস্যুতের খুশি নন। তারা বলছেন, বন্ড ইস্যুর ফলে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। চাইলেই জ্বালানি তেল আমদানি করতে তারা ব্যাংক থেকে এলসি করতে পারছে না। এদিকে গ্রীষ্মকালীন যখন প্রচ- বিদ্যুৎ সংকট, তখনো এসব ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জ্বালানি তেল আমদানি সংকটে পুরোদমে উৎপাদনে রাখা যায়নি। পরে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে ফার্নেস অয়েলের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পুরোদমে চালানোর জন্য আলটিমেটাম দিলে তারা চালু করে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বার্থে তেলভিত্তিক বিশেষ করে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রেখে জরুরি সংকট সমাধান করা হয়। তবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ চুক্তিতে মেয়াদ নবায়ন করা হচ্ছে। অর্থাৎ এসব কেন্দ্রকে আগের চুক্তির মতো বিদ্যুৎ না দিলে কোনো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে না। উল্লেখ্য, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি খরচ হয় ১৬ থেকে ১৮ টাকা। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর খরচ আরও বেশি। তবে সরকার অধিকাংশ ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের যুক্তিতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে- বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনার আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বৃহৎ আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্রমান্বয়ে অবসর দেওয়া হচ্ছে। ডিজেলভিত্তিক মোট ১৪০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক মোট ৩৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি এবং গ্যাসভিত্তিক মোট ৬১৩ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটিসহ সর্বমোট ২৩৯৮ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৪টি আইপিপি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অবসর দেওয়া হয়েছে। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রক্ষা, রিলায়াবিলিটি বৃদ্ধি এবং ট্যারিফ তুলনামূলক কম হওয়ায় কিছু কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৭৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৯টি এবং গ্যাসভিত্তিক ৫৫৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট। জ্বালানির সীমাবদ্ধতার কারণে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ক্ষমতায় চালানোর ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গ্যাসের অপ্রতুলতার এ বাস্তবতা বিবেচনায় ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ জরুরিভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়, ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট ও মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ঢাকা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এরই মধ্যে অবসর দেওয়া হয়েছে, বিধায় ঢাকা অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলা ও সিস্টেম রিলায়াবিলিটি রক্ষার স্বার্থে এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখার প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত না থাকায় গ্রিড সচল রাখা, তাৎক্ষণিক বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলা ও লোডশেডিং এড়ানোর লক্ষ্যে নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট, খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা প্রয়োজন। অন্যদিকে জুলদা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের হালিশহর ও শিকলবাহায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। সে বিবেচনায় গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলায় এ ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা প্রয়োজন।