ঘাতক কাউসার মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন

সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

নিজস্ব প্রতিবেদক
১০ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ঘাতক কাউসার মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন

বসে ও দাঁড়িয়ে ডিউটি করা নিয়ে কনস্টেবল মনিরুল ও কাউসারের মধ্যে মনোমালিন্য ছিল দীর্ঘদিনের। চাকরি ও বয়সে জুনিয়র মনিরুল সহকর্মীকে যোগ্য সম্মান দিতেন না বলেও অভিযোগ ছিল কাউসারের। দীর্ঘদিন মানসিক অবসাদে ভোগা কাউসার এসব ক্ষোভ থেকে গত শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে তর্কে জড়ান মনিরুলের সঙ্গে। কয়েক সেকেন্ড তর্কের পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই টাওরাস এসএমটি সাবমেশিন গান দিয়ে দুই দফা গুলি করে ঝাঁঝরা করে ফেলেন সহকর্মী মনিরুলকে। নিহত কনস্টেবলের ভাইয়ের করা মামলায় কাউসারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গুলশান থানা পুলিশ।

ঘাতক কাউসারের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার দাড়েরপাড়া গ্রামে। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়াত আলী। তার স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন জানান, ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কাউসার পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৬ সালের মাঝামাঝি তাদের বিয়ে হয়। তিনি বলেন, কাউসারের মানসিক সমস্যা ছিল। রাঙামাটির বরকলে চাকরি করার সময় তিনি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এরপর বিভিন্ন সময় সরকারিভাবেই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে অন্তত তিনবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল। নিয়মিত ওষুধও সেবন করতেন। কাউসারের কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে। নিলুফা জানান, কিছুদিন ধরে কাউসার খুবই কম কথা বলতেন। ঈদে কেনাকাটার জন্য বাড়িতে টাকাও পাঠিয়েছিলেন। সংসারে কোনো অভাব অনটন ছিল না। তবে চাকরি নিয়ে খুবই টেনশন করতেন তিনি। ছয় ঘণ্টার ডিউটি আট ঘণ্টা হতো। এ ছাড়া নানা বিষয় নিয়ে তিনি টেনশন করতেন।

শনিবার রাতে বারিধারার ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে কনস্টেবল মনিরুল ইসলামকে কনস্টেবল কাউসার আহমেদের গুলি করার দৃশ্যটি ধরা পড়েছে সিসিটিভি ক্যামেরায়। ফুটেজে দেখা যায়, বারিধারার ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে কনস্টেবল মনিরুলকে দুই ধাপে অসংখ্য গুলি করেন কনস্টেবল কাউসার। এতে দেখা যায়, প্রথমে গার্ড রুমের ভেতরে থাকা কনস্টেবল কাউসার আহমেদের সঙ্গে বাইরে থাকা কনস্টেবল মনিরুল ইসলামের কয়েক সেকেন্ড কথা হয়। এর ফাঁকেই ভেতর থেকে কাউসার খুব কাছ থেকে গুলি করলে মনিরুল রাস্তায় পড়ে যান। পরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে কাউসার গার্ড রুমের ভেতর থেকে বাইরে এসে রাস্তায় পড়ে থাকা মনিরুলের শরীর লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করেন। এরপরই নিথর হয়ে যান মনিরুল।

গুলশান থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, তারা ভিডিও ফুটেজ পেয়েছেন এবং সে অনুযায়ী দেখা যায় হত্যাকারী একজনই। এ ঘটনায় মনিরুলের ভাই কনস্টেবল মাহবুবুর হক মামলা করেছেন, যেখানে আসামি করা হয় কাউসারকে। তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলা হলে বিচারক সাত দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কারণ বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।

৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, মনিরুল ইসলাম অস্ত্র নিয়ে গার্ড রুমের বাইরে লাগোয়া ফুটপাতে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর কাউসার গার্ড রুমের ভেতর থেকে বাইরে আসেন। সামান্য দূরত্ব রেখে তারা কথা বলতে থাকেন। এরপরই কাউসার ভেতরে ঢুকে যান এবং গার্ড রুম লাগোয়া ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন মনিরুল। গার্ড রুমের থাই গ্লাস সরিয়ে কাউসারের সঙ্গে মনিরুলের আবার তর্কাতর্কি হয়। মনিরুল গার্ড রুমের কাছাকাছি আসতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাউসারের অস্ত্র গর্জে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মনিরুল ফুটপাত থেকে রাস্তায় পড়ে যান এবং পরে আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কাউসার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে এসে তার শরীর লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করেন। এরপরই মনিরুলের দেহ নিথর হয়ে যায়।

ওসি মাজহারুল জানান, মনিরুলের মরদেহ কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর তা সেই পথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে অতিক্রম করা সাজ্জাদ হোসেনের চোখে পড়ে। তিনি জাপান দূতাবাসের গাড়িচালক। সাজ্জাদ মরদেহটি দেখে এগিয়ে যান। তখন কাউসার তাকে লক্ষ্য করেও কয়েক রাউন্ড গুলি করেন। আহত হয়ে সাজ্জাদ বেশ কিছুদূর গিয়ে পুলিশের একটি গাড়ির সামনে পড়ে যান। পরে তাকে পুলিশই ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যায়।

পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট ৩৮ রাউন্ড গুলি চালিয়েছেন কাউসার। কনস্টেবল মনিরুল ইসলামের দেহ তাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। অন্যদিকে সাজ্জাদের শরীরের তিনটি গুলি লাগে। এর দুটি পেটে এবং একটি হাতে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সাজ্জাদকে গুলি করাকালেই কাউসারের অস্ত্রে গুলি আটকে যায়। এরপরই তিনি অস্ত্র ফুটপাতে রেখে সিগারেট ধরান এবং অস্ত্র থেকে একটু দূরে আসেন। তারপর পেছন থেকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে জাপটে ধরে হেফাজতে নেন।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, গুলি করে হত্যার পর কাউসারের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি পালাননি। ধরা পড়ার পর কাউসার দাবি করেন, গুলির ঘটনার কিছুই মনে নেই। নাম জিজ্ঞাসা করলেও নিজের নাম এলোমেলো বলেন।

তবে গত শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে মনিরুল নিহত হলেও ১৯ ঘণ্টা পর লাশের ময়নাতদন্ত হয়। মনিরুলের মরদেহ গতকাল সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হলেও সন্ধ্যা ৭টার পর ময়নাতদন্ত করা হয়। গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহনুর রহমান জানান, পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদন হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ গ্রহণ না করে তারা ম্যাজিস্ট্রেটের করা সুরতহাল প্রতিবেদন চায়। বিকালের পর জেলা প্রশাসক একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির অনুমতি দেন।