রাজস্ব আহরণে চাপে থাকবে এনবিআর ও ভোক্তা

আবু আলী
০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
রাজস্ব আহরণে চাপে থাকবে এনবিআর ও ভোক্তা

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আহরণে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এনবিআরকে আগামী অর্থবছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা বেশি। মূল্যস্ফীতির কারণে অধিকাংশ নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এতে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যয় করতে পারছেন না অনেকে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকায় পরিস্থিতির শিগগিরই পরিবর্তন হওয়ার লক্ষণও নেই। সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের বিশাল এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে এনবিআরকে রাজস্ব আহরণে বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা ও সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর আগেই পার করেছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সীমিত আয়ের মানুষজন। দেশে বিগত ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার পথনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। নানা কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে আমাদানি পণ্যের দাম বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধি। এই মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ন্ত্রণে পথনকশা নেই। ফলে এনবিআরের পক্ষে লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে। সব মিলিয়ে অর্থবছরে পুরো সময়ই রাজস্ব আহরণে চাপে থাকবে এনবিআর। বিশ^ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে দেওয়া রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটা অসম্ভবই বলা চলে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাজেটে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকের যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তাকে উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তার মতে, রাজস্ব আহরণ, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে তার পথরেখা দেওয়া হয়নি।

জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা জিএম কাদের বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের মধ্যে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঘাটতি হচ্ছে। দেশের রাজস্ব বা অন্যান্য খাত থেকে যা আয় হচ্ছে তার চেয়ে ব্যয় হচ্ছে বেশি। ঘাটতি মেটানো হচ্ছে সম্পূর্ণ দেশি ঋণ এবং বিদেশি ঋণ দিয়ে। রাজস্ব আয় বাড়াতে করের হার বাড়ানো হয়েছে। বেশির ভাগ আয়ের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে পরোক্ষ করের মাধ্যমে। ফলে সাধারণ জনগণের ওপর কারের বোঝা বাড়বে।

জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিদিন এনবিআরকে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে। এর মধ্যে আয়কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ২২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বেশি। মূল্যসংযোজন কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের চেয়ে ১৮ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা বেশি। এতে সব মানুষের ওপর করের চাপ বাড়বে বলে মনে করে বিশ্লেষকরা। আবার সম্পূরক শুল্ক আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, যা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা বেশি। আমদানি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বেশি। রপ্তানি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৪ কোটি টাকা বেশি। আবগারি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা বেশি। অন্যান্য কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৪৪০ কোটি টাকা বেশি। রাজস্ব আহরণে তিন খাতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। মধ্যবিত্তদের ওপর চাপটা থাকবে বেশি। তবে এ চাপ এনবিআরের জন্যও কম নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্কার ছাড়াই বিপুল রাজস্ব আদায় বরাবরের মতো এবারও চাপে থাকতে হবে এনবিআরকে। এ ছাড়া বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আহরণের জন্য যে ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন, নীতি সংস্কার এবং অন্যান্য সক্ষমতা দরকার তা অনেক বেশি অসংগতিপূর্ণ বলে মনে করেন তারা।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর বিষয়ে জানিয়েছেন, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সরকার বেশকিছু সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে রাজস্ব এবং করদাতার সংখ্যা বাড়বে। অর্থ বিভাগের প্রক্ষেপণ অনুসারে ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে রাজস্ব জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রত্যেকটা জায়গায় একটা অস্বস্তি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজস্ব আহরণ, ব্যয় ব্যবস্থাপনা, নিম্ন ব্যয় করার সক্ষমতা, ব্যাংক খাত থেকে উচ্চহারে ঋণ নেওয়া, ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থা, তারল্য সীমিত হয়ে আসা, রপ্তানি নিম্নমুখী, রেমিট্যান্সপ্রবাহ না বাড়া, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে স্থবির অবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানির দিকে এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হার অনেকবার পরিবর্তন করা। তিনি বলেন, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা অনেক গর্ব করতাম, অনেক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেখানেও নিম্নগতি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাজেটে অর্থনীতির মূল সূচকগুলো আগামী অর্থবছরে প্রতিটি চলকে এমন প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের জন্য সেগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সাযুজ্য নেই।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ আমাদের সময়কে বলেন, অর্থনীতিতে তেজিভাব আনতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি এবং পরোক্ষ কর কমাতে হবে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রযুক্তিগত, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে কাগজবিহীন ও স্বচ্ছ কর পদ্ধতি করা দরকার। কালোটাকা সাদা করার বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কঠোর বার্তা দিতে হবে। এরপর যাদের কাছে পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে নয় বরং সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কর ফাঁকি বন্ধ করতে পারলে রাজস্ব আহরণ সম্ভব।