আমিন-স্বপন চক্রে হাজারো মানুষের স্বপ্নের সমাধি
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ধস
মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর, যিনি দাতো শ্রী আমিন নামে সমধিক পরিচিত এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপনের করা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বন্ধ হয়ে গেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। দেশটিতে গমনেচ্ছু অসংখ্য মানুষ হারিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এ দুজনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট। বেস্টিনেটের অভিবাসন বিষয়ক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এফডব্লিউসিএমএস। আর এই এফডব্লিউসিএমএসের ডিজিটাল জালিয়াতির কারণেই বর্তমানে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভিটামাটি, সহায় সম্বল বিক্রি করে প্রবাসের স্বপ্ন দেখা হাজারো মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছেন। সর্বোপরি এর খেসারত দিতে হচ্ছে দেশকে, হারাতে হচ্ছে শতকোটি টাকার রেমিট্যান্স। এমন অভিযোগ তুলেছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আমিন-স্বপন চক্রের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু প্রায় ৩০ হাজার কর্মীর ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যদিও প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, এ সংখ্যাটি প্রায় ১৬ হাজার। প্রসঙ্গত, গত ৩১ মে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় উল্লিখিত সংখ্যক কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। এ মওকায় মে মাসের শেষ দশ দিনে মালয়েশিয়াগামী প্রায় ৩০ হাজার যাত্রীর প্রত্যেকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা
করে দেড়শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে টিকিটচক্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকেই বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী বিতর্কিত এফডব্লিউসিএমএস প্রযুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের সে দাবি উপেক্ষা করেই বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া শ্রমবাজারবিষয়ক চুক্তিতে পদ্ধতিটি অনুমোদন পায়। আর এর পরই শুরু হয় আমিন-স্বপন সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুরু থেকেই বলা হয়েছিল, বিশে^র অন্য ১৪টি দেশ থেকে মালয়েশিয়া যে পদ্ধতিতে কর্মী নেয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেন সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু বৈধ সব এজেন্সিকে সুযোগ না দিয়ে ২৫-৩০ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে তাদের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়া হয়েছে। এ সিন্ডিকেটের কারণেই আজকের এই পরিণতি।
শুধু তা-ই নয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, আমিন-স্বপন চক্র নানা অজুহাতে সরকারি খরচ ৭৯ হাজার টাকার বাইরে কর্মীপ্রতি অতিরিক্ত ৩ লাখ ৬২ হাজার ৫শ টাকা করে নিয়েছে। এর বাইরেও জনপ্রতি চাহিদাপত্র বিক্রি করেছে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকায় এবং অনুমোদনের বিপরীতে মাথাপিছু নিয়েছে ৪০ হাজার ৫শ টাকা করে। এভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে চক্রটি এখন কর্মীদের কাজ দিতে পারছে না।
একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতি ব্যবহার করে রুহুল আমিন স্বপন এবং সরকারের সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, এমনকি সরকারপ্রধানের আশপাশের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তির চক্র ১৪ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা অসহায় মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। সেসব কর্মী এখন মালয়েশিয়ায় কাজ পাচ্ছেন না। পরিস্থিতির উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত, তদন্তের মাধ্যমে তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবিও তুলেছেন তারা।
এদিকে ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের ডেটলাইনকে ঘিরে মে মাসের শেষ দশ দিনে প্রায় ৩০ হাজার যাত্রীর কাছ থেকে টিকিটের অজুহাতে মাথাপিছু অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা করে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
পুরো প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক দাতো শ্রী আমিন
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের কর্মী প্রেরণের বিষয়টি পুরোপুরি দাতো শ্রী আমিনের হাতের মুঠোয়। এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয় তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এফডব্লিউসিএমএসের মাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে ই-রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির মাধ্যমে কোটা অনুমোদন; অটো রোটেশনে একক কর্তৃত্ব, মাইগ্রামসের মাধ্যমে কর্মী নিবন্ধন এবং মেডিক্যাল টেস্টের নামে কলিং ভিসায় হস্তক্ষেপ। এ ছাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করাতে হয় আমিনের মালিকানাধীন বেস্টিনেটের নির্বাচিত মেডিক্যাল সেন্টারে। ই-ভিসার নিয়ন্ত্রণকারী এমইএফসি নামের প্রতিষ্ঠানটিও বেস্টিনেটেরই। ই-এমবাসি পোর্টালের সত্যায়ন প্রক্রিয়াও হয়ে থাকে এফডব্লিউসিএমএসের মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এফডব্লিউসিএমএসের দৌরাত্ম্যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক অভিবাসনে একদিকে যেমন গতি ধীর হয়ে গেছে, অন্যদিকে তেমনই খরচও অনেক বেড়ে গেছে। এখানেই শেষ নয়। এফডব্লিউসিএমএসের একক ক্ষমতার কারণে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা রীতিমতো ‘লুট’ হয়ে গেছে। এর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরাÑ
এক. এফডব্লিউসিএমএসের মাধ্যমেই কর্মীদের অ্যাপ্রোভাল দেন নিয়োগকর্তা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কর্মীপ্রতি ১২শ-১৫শ রিঙ্গিত (৪০ হাজার টাকা প্রায়) বাড়তি আদায় করা হয়।
দুই. রেজিস্ট্রেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায়ও ক্ষেত্রবিশেষে ৪-৫ গুণ পর্যন্ত ফি আদায় করা হয় মাইগ্রামসের মাধ্যমে।
তিন. অটো রোটেশন বা অটো অ্যালোকেশনও এফডব্লিউসিএমএসের আওতাধীন। এতে করে প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের ফাঁদে ফেলে মাথাপিছু বাড়তি দেড় লাখ টাকা করে আদায় করেছে বলে একাধিক সূত্রের খবর।
চার. বেস্টিনেটের স্বেচ্ছাচারিতা। প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি-শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রিক্রুটিং এজেন্সির কোনো সদস্য প্রতিবাদ করলেই সেই এজেন্সির সিস্টেম ব্লক করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্থগিত করা হয় মাইগ্রামস রেজিস্ট্রেশন ও বায়োমেডিক্যাল সার্ভিস। এতে কর্মী রপ্তানিতে অনিশ্চয়তাসহ বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় সংশ্লিষ্ট এজেন্সিকে।
পাঁচ. বেস্টিনেটের এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতির মাধ্যমে রিক্রুটমেন্ট ভিসা-ট্রেডিং মুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল সরকারকে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে একচেটিয়া কর্মী প্রেরণ এবং পুরো নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে প্রতিটি ধাপে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া। শুরুতে সরকারকে বলা হয়েছিল, শ্রমিক বা রিক্রুটিং এজেন্সির কোনো ধরনের ভিসা খরচ লাগবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এফডব্লিউসিএমএসের দৌরাত্ম্যে প্রতিটি ভিসায় বাড়তি গুনতে হয়েছে ৫-৬ হাজার রিঙ্গিত (১ লাখ ৬২ হাজার টাকা প্রায়)।
এ ছাড়া বিমান ভাড়া বাবদ ৫০-৬০ হাজার, ই-ভিসা বাবদ ৭ হাজার, বিএমইটি ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হয়েছে প্রতিটি কর্মীকে।
ছয়. শ্রমিক নিয়োগের আবেদন বাবদ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা, মাইগ্রামস রেজিস্ট্রেশন ও বায়োমেডিক্যাল বাবদ ৫ হাজার ৪শ টাকা, অটো অ্যালোকেশনের সিস্টেম ফি বাবদ দেড় লাখ টাকা, ভিসা ট্রেডিং বাবদ ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা নিয়েছে এফডব্লিউসিএমএস। অর্থাৎ এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয় দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯শ টাকা। এর বাইরে বিমান ভাড়া, বিএমইটি ও আনুষঙ্গিক ব্যয়, রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস চার্জসহ মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৯শ টাকা।
রেসপন্সিবল বিজনেস অ্যালায়েন্সের (আরবিএ) অন্তর্ভুক্ত মালয়েশিয়ার কয়েক হাজার কোম্পানিতে ২-৩ লাখ শ্রমিকের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এফডব্লিউসিএমএসের দুর্নীতির কারণে এটি আলোর মুখ দেখছে না। অথচ এসব কোম্পানি প্রবাসী কর্মী নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অভিবাসনের সব প্রকার ব্যয়ভার বহন করে। প্রতিবেশী নেপালসহ অনেক দেশই এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।
৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি
নির্ধারিত সময়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরও যেসব কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি, তার কারণ অনুসন্ধানে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, কমিটি আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়ে আরও বলেন, ৩১ মে পর্যন্ত বিএমইটি থেকে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়া গিয়েছেন। সেই হিসাবে ১৬ হাজার ৯৭০ জনের কমবেশি যেতে পারেননি। যারা এ সমস্যার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিন্ডিকেটের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে দেশ জনশক্তি নেবে, তারা চায় বলেই সিন্ডিকেট হয়েছে। তবে সরকার কোনো সিন্ডিকেটে বিশ্বাস করে না। সরকার অনুমোদিত এজেন্সিগুলো যেন লোক পাঠাতে পারে, সেটাই চায় সরকার।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার শিগগিরই খোলার বিষয়ে আশা প্রকাশ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হককে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
সিন্ডিকেট হলে বিপদ আসবেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন ড. তাসনীম সিদ্দিকী গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আমরা সবাই বলেছিলাম, কর্মী প্রেরণে সিন্ডিকেট হলে বিপদ আসবেই। কেউ শোনেনি। এখন সত্যিই বিপদ নেমে এসেছে। নেপালসহ অন্য ১৪টি দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়া এমন চুক্তি না করলেও বাংলাদেশের সঙ্গে করতে পেরেছে। অথচ অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে কর্মী প্রেরণ অনেকটাই উন্মুক্ত রয়েছে। সেসব দেশে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই উল্টোটা ঘটেছে। এর পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে বিদেশে গমনেচ্ছু সাধারণ অসহায় মানুষকে।
এফডব্লিউসিএমএসের খেসারত দিচ্ছে দেশ জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশকে এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতির খেসারত দিচ্ছে দেশ। কিছু মানুষের লোভের কারণে পুরো জনশক্তি রপ্তানি খাতই এখন হুমকির মুখে। তিনি বলেন, নেপালসহ বিশে^র অন্য দেশগুলো যেভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করেছে, আমরাও তো একই পদ্ধতির দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দাবি না শুনে সিন্ডিকেটকেই অনুমোদন দেওয়া হলো। এর ফলে লাইসেন্সধারী শত শত এজেন্সি কর্মী পাাঠানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বাজার হারিয়েছে সুষম প্রতিযোগিতা। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে জিম্মি হয়েছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতি থেকে বাংলাদেশকে সরে আসতে হবে। নয়তো দুর্দশা কাটবে না।