শেয়ার-বন্ডে আগ্রহ কমছে বিদেশিদের
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগই শুধু নয়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বন্ড ও শেয়ারে (পোর্টফোলিও বিনিয়োগ) আগ্রহ কমছে বিদেশিদের। গত তিন বছর ধরে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একই সময়ে বিদেশিদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে।
সর্বশেষ, ২০২৩ সালে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমেছে প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ। এর আগের বছরে কমার হার ছিল আরও বেশি, প্রায় ২৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মার্কিন ডলারের সংকট ও বিনিময় হারের ঘন ঘন পরিবর্তন, দেশে দেশে সুদের হার বৃদ্ধি, সেকেন্ডারি বন্ড বাজার শক্তিশালী না হওয়া এবং শেয়ারবাজারে মৌলভিত্তির কোম্পানির অভাবে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ কমছে। এর বাইরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও বিনিয়োগ কমার ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে।
শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির উদ্যোগে বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচারণামূলক রোডশো করা হচ্ছে। বন্ডে বিনিয়োগ আকর্ষণেও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরপরও পোর্টফোলিও বিনিয়োগ সেভাবে হচ্ছে না। উল্টো বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। গত কয়েক বছর এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি মার্কিন ডলারকে ক্রমে শক্তিশালী করেছে। এতে দেশে দেশে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। এটা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের সব দেশেই সুদের হার বাড়ানো হয়। আবার ডলার সংকটের কারণে দেশে ঘন ঘন বিনিময় হারের পরিবর্তন করা হয়েছে। এর বাইরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও একটা ইস্যু ছিল। এসব কারণে বিদেশিরা শেয়ার ও বন্ডে বিনিয়োগে কম আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় পুনঃবিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করায় এনআরবি বন্ডে বিনিয়োগ কমে গেছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ নিয়ে গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই প্রতিবেদন বলছে, গত বছর দেশে মোট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হয়েছে ২০৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের চেয়ে এটি ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ কম। অথচ করোনা মহামারী শুরুর বছর ২০২০ সালে দেশে সর্বোচ্চ ৪৭৩ কোটি ডলারের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আসে। এটি ছিল এর আগের বছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। তবে এরপর থেকেই টানা কমছে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ। ২০২১ সালে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ নেমে আসে ৩৬০ কোটি ডলারে (কমার হার ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ)। ২০২২ সালে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ রেকর্ড ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ২৫৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারে। আর গত বছর সেটি আরও কমে নেমে এসেছে ২০৮ কোটি ডলারে।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায় : গত কয়েক বছর ধরেই শেয়ারবাজারে বিদেশিদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২৩ সালে বিদেশিরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন মাত্র ৯ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। একই সময়ে ১০ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ তুলে নেন। ফলে বিদেশিদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ দাঁড়ায় ঋণাত্মক ৮১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। ২০২২ সালেও শেয়ারবাজারে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ১৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। সে বছর বিদেশিরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন ১৩ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। একই অর্থবছরে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ তুলে নেন ৩৩ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের। এ ছাড়া ২০২১ সালে বিদেশিরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন ৩২ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। আর শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ তুলে নেন ৬১ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। ফলে ওই অর্থবছরে বিদেশিদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক ছিল ২৯ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের পুঁজিবাজারের বেশ কিছু খাতের কোম্পানিতে বিদেশিদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ রয়েছে ওষুধ ও কেমিক্যাল খাতে। এরপরই ছিল ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা ও মিউচুয়াল ফান্ডে। এ ছাড়া খাদ্য ও আনুষঙ্গিক, টেলিযোগাযোগ, স্টিল ও প্রকৌশল, বস্ত্র, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, সিমেন্ট ও যোগাযোগ খাতের কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ বেশি রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা। এরপরই আছে যুক্তরাজ্য, লুক্সেমবার্গ, সিংগাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রিটিশ ভার্জিন, কানাডা, মরিশাস, পাকিস্তানের বিনিয়োগকারীরা।
বন্ডেও কমছে বিনিয়োগ : সরকারি ট্রেজারি বন্ড ও তিন ধরনের এনআরবি বন্ড যথা- ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ মুদারাবা পারপিচুয়াল বন্ড ও ব্র্যাক ব্যাংকের ফিক্সড কুপন বন্ডেও বিনিয়োগ রয়েছে বিদেশিদের। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি- বেসরকারি এসব বন্ডে গত বছর বিদেশিরা বিনিয়োগ করেন ৯৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ১৩১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার (কমার হার ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ)। ২০২১ সালেও এসব বন্ডে বিনিয়োগ কমেছিল। ওই বছর বন্ডে বিনিয়োগ আসে ১৬৭ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, এটি তার আগের বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম ছিল।
বাড়ছে বিনিয়োগ প্রত্যাহার : বিদেশিরা যে শেয়ার ও বন্ড বিক্রি করে নিজ দেশে অর্থ প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন, তা বিদেশিদের নামে খোলা নন-রেসিডেন্ট ইনভেস্টমেন্ট টাকা অ্যাকাউন্টের (নিটা) লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনায় আরও স্পষ্ট হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদেশিরা গত বছর নিটা হিসাবের মাধ্যমে বাংলাদেশে মাত্র ৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার এনেছেন। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছেন প্রায় ৩০ কোটি ২৪ লাখ ডলার। ফলে নিটা হিসাবের নিট স্থিতি ঋণাত্মক হয়েছে ২০ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। ২০২২ সালে নিটা হিসাবের নিট স্থিতি ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ ছিল আরও বেশি, এর পরিমাণ ২২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে বিদেশিরা বাংলাদেশে পোর্টফোলিও বিনিয়োগের জন্য মাত্র ১৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার আনেন। এর বিপরীতে দেশ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন ৩৮ কোটি ১১ লাখ ডলার। আর ২০২১ সালে নিটা হিসাবের নিট স্থিতি ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ ছিল ২৯ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।
নিট এফডিআইও কমেছে : গত বছর দেশে প্রায় ৩০০ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। এটি তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ কম। এর মধ্যে নতুন বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ। এফডিআই কমার পেছনেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ডলারের সংকট ও বিনিময় হারের ঘন ঘন পরিবর্তন, অর্জিত মুনাফা যথাসময়ে প্রত্যাবাসন করতে না পারা, সুশাসনের অভাব ও ব্যবসা সহজ করার সূচকে পিছিয়ে-পড়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন