বছর বছর সড়কে টোল বাড়ানোর আয়োজন
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের টোল আদায় নীতিমালা সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। এতে সেতু পারাপারে যানবাহনের টোলের পরিমাণ বাড়বে। এ জন্য বাড়ানো হবে ভিত্তি টোল। একই সঙ্গে মহাসড়ক ব্যবহারের জন্যও যানবাহনকে টোল দিতে হবে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে চারটি মহাসড়কের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে প্রতিবছরই টোল হার বৃদ্ধির সুযোগ পাবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, টোল বৃদ্ধি নয়, বাজার মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) ভিত্তিতে টোল নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর সিপিআই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য ও সেবার মূল্য পরিবর্তনের পরিমাপ পদ্ধতি, যার দ্বারা সরকার সাধারণ স্তরের মূল্যস্ফীতি হিসাব করে থাকে।
বর্তমানে ২০১৪ সালের ২৪ মার্চ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত নীতিমালা অনুযায়ী টোল আদায় করে থাকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ১০ বছর পর এখন সেই নীতিমালা সংশোধন করে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আসন্ন ঈদের পর নীতিমালাটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর চিন্তা রয়েছে।
রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এবং টোল আদায়ে ব্যয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে- এমন যুক্তিতে ২০২১ সালের জুনে টোল বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল ‘ভিত্তি টোল, টোলহার সংশোধন ও যৌক্তিকীকরণ কমিটি’। এ কমিটির সদস্যরা বলছেন, টোলহার বৃদ্ধি নয়, সমন্বয় করা হচ্ছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সূত্র জানায়, সংশোধিত নীতিমালার খসড়ায় সড়ক ও সেতুতে সিপিআইয়ের ভিত্তিতে টোল নির্ধারণের প্রস্তাব রয়েছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সম্পর্কিত এ সূচকের পরিবর্তনের ফলে বছরে বছরে বাড়তে পারে টোল। এর মধ্যে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী প্রথমে চার মহাসড়ক- ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-তামাবিলে চলাচল করা যানবাহন থেকে টোল আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রস্তাবিত নীতিমালা সরকারের অনুমোদন পেলে ভিত্তি টোল বাড়বে।
বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, সেতু ব্যবহারের জন্য যানবাহনের টোল নির্ধারিত হয় মাঝারি ট্রাকের অনুপাতে, যাকে ভিত্তি টোল বলা হয়। জাতীয় মহাসড়কের ৭৫১ থেকে এক হাজার মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুর ভিত্তি টোল হলো ৩০০ টাকা। অর্থাৎ মাঝারি ট্রাক এই দৈর্ঘ্যরে সেতু পার হলে টোল দিতে হয় ৩০০ টাকা। এই ভিত্তিতে একটি ট্রেইলারের টোল ধরা হয় এর আড়াই গুণ বা ২৫০ শতাংশ বেশি। আর বাসের টোল মাঝারি ট্রাকের ৯০ শতাংশ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ফলে সে হিসাবে এই দৈর্ঘ্যরে সেতুতে ট্রেইলারের টোল ৭৫০ টাকা, বড় ট্রাকের ৬০০, বড় বাসের ২৭০, প্রাইভেট কারের ৭৫ এবং মোটরসাইকেলের ১৫ টাকা।
নীতিমালা অনুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়ে বা গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে সেতুর ভিত্তি টোল হলো ৪০০ টাকা। অন্যান্য সড়কে সেতুর ভিত্তি টোল হচ্ছে জাতীয় মহাসড়কে ৩০০, আঞ্চলিক ও সীমান্ত মহাসড়কে ২০০ এবং জেলা সড়কে ১০০ টাকা। এক হাজারের মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে সেতুর টোল হচ্ছে ভিত্তি টোলের ১২৫ শতাংশ বা ৩৭৫ টাকা। ৫০১ থেকে ৭৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুর টোল ভিত্তি টোলের ৭৫ শতাংশ বা ২২৫ টাকা। ২০১ থেকে ৫০০ মিটারের সেতুর ভিত্তি টোল হলো ভিত্তি টোলের ৫০ শতাংশ বা ১৫০ টাকা।
সড়ক ও মহাসড়কের টোল আদায়েও সংশোধনের প্রস্তাব রয়েছে খসড়ায়। এতে এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটারের ভিত্তি টোল প্রস্তাব করা হয়েছে ২ টাকা। অর্থাৎ একটি মাঝারি ট্রাক এক্সপ্রেসওয়েতে এক কিলোমিটার চললে ২ টাকা টোল দিতে হবে। ফলে সেতুর মতো সড়কেও অন্যান্য যানবাহনের টোল নির্ধারিত হবে ভিত্তির অনুপাতে। ট্রেইলারের টোল মাঝারি ট্রাকের আড়াই গুণ বা ২৫০ শতাংশ। বাসে ১০০ কিলোমিটারে ১৮০ টাকা দিতে হবে। মোটরসাইকেলে ১০ টাকা লাগবে।
জাতীয় মহাসড়কে টোল আগের মতো দেড় টাকা, আঞ্চলিক মহাসড়কে ১ টাকা এবং জেলা সড়কে ৫০ পয়সা রাখার প্রস্তাব রয়েছে নীতিমালার খসড়ায়। নতুন যোগ হয়েছে সীমান্ত সড়ক। এতে ১ টাকা ভিত্তি টোলের প্রস্তাব রয়েছে।
বলে রাখা ভালো, দেড় হাজার মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণের দায়িত্ব সেতু বিভাগের। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে পদ্মা সেতু, যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতু, মুক্তারপুর সেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল আদায় করা হয়। সওজ এবং সেতু কর্তৃপক্ষের অভিন্ন টোল নীতিমালার প্রস্তাব থাকলেও তা হচ্ছে না। সওজের ৫৪টি সেতু, ৪২ ফেরি, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নামে পরিচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক এবং তিন মহাসড়কে দৈর্ঘ্যরে ভিত্তিতে টোল আদায় করা হয়।
গত রবিবার সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরীর সভাপতিত্বে নতুন টোল নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। এ বিষয়ে তিনি গত বৃহস্পতিবার আমাদের সময়কে জানান, সভায় নীতিমালার কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব থাকলেও টোল বৃদ্ধিতে সবাই একমত হয়েছেন। তবে আরেক দফা বৈঠক হওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি। বলেন, টোল নীতিমালাটি অনেক দিন আগের। এটি সংশোধন করা হচ্ছে। শিগগির চূড়ান্ত হবে নীতিমালা। এরপর তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদে পাঠানো হবে।
সড়ক পরিববহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী টোল বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল কমিটি। এতে টোল অনেক বেশি বাড়ত। তাই ভোক্তা মূল্য সূচক অনুযায়ী টোল নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সূত্র অনুযায়ী, বর্তমান অর্থবছরের পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের ভোক্তা মূল্য সূচক থেকে ২০১৪ সালের মূল্য সূচককে বিয়োগ করা হবে। বিয়োগ ফলকে ভিত্তি অর্থবছরের মূল্য সূচক দিয়ে ভাগ করা হবে। এই ফলাফলকে ভিত্তি টোল দিয়ে ভাগ করে, ভাগফলকে শূন্য দশমিক ৩ দিয়ে গুণ করা হবে। গুণফলের সঙ্গে যোগ হবে ২০১৪ সালে ভিত্তি টোল।
খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২২ সালের মূল্য সূচক ধরে হিসাব করে জাতীয় মহাসড়কের সেতুর ভিত্তি টোল হবে ৩৪৫ টাকা। অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভিত্তি টোল একই হারে বাড়বে। জাতীয় মহাসড়কের সেতুতে টোল বৃদ্ধি ১৫ শতাংশ হলে, অন্যান্য ক্ষেত্রে তা আরও বেশি হবে। ২০২৪ সালের ভোক্তা মূল্য সূচক ধরে হিসাব করা হলে, তা আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
প্রসঙ্গত, গত ২৫ মার্চ সড়ক পরিবহন সচিবের সভাপতিত্বে এক সভায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট এবং সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে টোল আদায়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগাতে মহাসড়কে টোল আদায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাধিক নির্দেশনা রয়েছে। তা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।