কোম্পানির আগ্রাসী মার্কেটিংয়ে পকেট ফাঁকা হচ্ছে রোগীর

আজাদুল আদনান
২৭ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
কোম্পানির আগ্রাসী মার্কেটিংয়ে পকেট ফাঁকা হচ্ছে রোগীর

চলতি বছরের পাঁচ মাসে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়া জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের দাম কয়েক দফায় ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। করোনা মহামারীর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দাম বেড়েছে। দাম বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী মার্কেটিং নীতি। কোম্পানিগুলোর বক্তব্যÑ তাদের ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক চলে যায় চিকিৎসক, বিপণন ও মোড়কে। ওষুধের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার প্রয়োজন বলে মনে করেন ওষুধ প্রযুক্তিবিদরা। তারা বলছেন, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে এর প্রয়োগ নেই, একে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে কোম্পানিগুলো।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৩৫ হাজার ২৯০টি ব্র্যান্ডের ৪ হাজার ১৮০টি অত্যাবশ্যকীয় বা জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে মাত্র ১১৭টি জেনেরিকের ৪১৭টির মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার, যা শতকরায় ৩ শতাংশেরও কম। বাকি ৯৭ শতাংশ ওষুধের দাম নির্ধারণ করে উৎপাদক কোম্পানি। দাম নিয়ন্ত্রণে ৩০ বছর আগে তৈরি হওয়া নীতিমালা পরে আর সংশোধনও করা হয়নি। এ ছাড়া বাড়েনি সরকারের নিয়ন্ত্রিত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাও।

গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার ফলে এর উচ্চ বিজ্ঞাপন খরচ কমানো সম্ভব কিনা’Ñ এ নিয়ে এক আলোচনাসভায় জানানো হয়, ওষুধ উৎপাদনে কোম্পানিগুলো ব্যয় করছে ঠিকই, কিন্তু সেটি যাচ্ছে আগ্রাসী মার্কেটিংয়ের পেছনে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, কোম্পানিগুলো মোট ব্যয়ের ২৯ শতাংশই খরচ করছে মার্কেটিংয়ে। এতে করে ৩ টাকার ওষুধ হয়ে যাচ্ছে ১৫ টাকা। চিকিৎসকদের নানা উপঢৌকন প্রদান, বিক্রেতাদের নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি মোড়কে ব্যয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে। এতে বাড়ছে ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয়।

এরিস্টো ফার্মা লিমিটেডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘এসি, গাড়ি, বাড়ি, নগদ ক্যাশ, বিদেশ ভ্রমণÑ এমন কিছু নেই, যা চিকিৎসকদের দিতে হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসকদের প্রমোশন খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে। আমাদের মোট ব্যয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ খরচ হয় তাদের পেছনে। ১৫ শতাংশ যায় অন্যান্য মার্কেটিংয়ে। ওষুধ বিক্রেতাদেরও নানা সুবিধা দেওয়া লাগে। এ ছাড়া মোড়কেও ব্যয় একেবারে কম নয়।’

নামসর্বস্ব কোম্পানিগুলোর কারণে ওষুধের দাম বাড়ছে বলে মনে করেন ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান। হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপক আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশে দুশর মতো ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানি অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করছে। এর মধ্যে অনেক নামসর্বস্ব কোম্পানিও রয়েছে। যাদের কারণে ওষুধের দাম বাড়ছে। অনেক সময় নানা সুবিধা নিয়ে চিকিৎসকরা তাদের ওষুধ লেখেন। এ কারণেও শতভাগ কোয়ালিটির ওষুধ তৈরি করেও মার্কেটিংয়ে আলাদা জোর দিতে হয়।’

নিয়ম অনুযায়ী, সরকারের আওতাধীন ওষুধের দাম বাড়াতে হলে আবেদন করতে হবে। এই নিয়ম মেনে সর্বশেষ ২০২২ সালে দাম বৃদ্ধির আবেদন করলে ১৯টি জেনেরিকের ৫৩টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তবে গত এক বছরে সরকার নিয়ন্ত্রিত ১১৭টি ওষুধের বাইরে ৯৭ শতাংশের দাম দফায় দফায় বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে গত পাঁচ মাসে ৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

এ সময়ে সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি, অ্যাজমার ওষুধের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভিটামিন, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের। এর মধ্যে অধিকাংশ ওষুধের দাম কোনো ঘোষণা ছাড়াই বেড়েছে।

ওষুধের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে গত ২৯ এপ্রিল হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন করে ক্যাব। এর পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে রুল দিয়েছেন আদালত।

ওষুধের চড়া দামের পেছনে ডলারের উচ্চমূল্যকে সামনে আনছে ওষুধ ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ওষুধ শিল্প সমিতি। তাদের দাবি শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে দাম আরও বাড়ানোর বিকল্প নেই। ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, ‘আমার টাকা আছে কিন্তু কাঁচামাল কিনতে হচ্ছে ডলারে। এক সময় প্রতি ডলার ৮৪ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন তা ১২০ টাকা। এতে করে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) পেতে নানা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। এ ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। এসব মিটিয়ে ওষুধ ব্যবস্থা এখন টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

ডিজিডিএর পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘ব্যবসায়িক কিছু পলিসি থাকে। যে কারণে একই ওষুধ একেক কোম্পানির একেক দাম। যেগুলো বেশি চলে সেগুলোর দাম একটু বেশিই বৃদ্ধি পায়। সেই লাভ থেকেই মার্কেটে নিজেদের টিকিয়ে রাখে কোম্পানিগুলো। একেবারে লাভ না করলেই নয়, এমন দাম নির্ধারণ করা হয়।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দরকার সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ওষুধের দোকান, সেখানে আছে আড়াই লাখের মতো। এখানে সরকারকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকদের ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহার করার প্র্যাকটিস করানো গেলে এসব অবৈধ সুবিধা প্রদান কমে আসবে।’