ভিডিও কলে হত্যার বর্ণনা তুলে ধরল কিলার শিমুল
ঢাকা থেকে ভিডিওকলে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন মিন্টো রোডে পুলিশ রিমান্ডে থাকা ঘাতক দলের প্রধান শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ। তার এই বর্ণনা দেওয়ার সময় কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদসহ দুই দেশের পুলিশ কর্মকর্তারা।
ভিডিওকলে ফ্ল্যাটের হত্যাকাণ্ডের স্থান, মাংস থেকে হাড় আলাদা করার জায়গা ও বেরিয়ে যাওয়ার স্থানসহ প্রত্যেকটি স্থানের বর্ণনা দেন আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া। অপহরণ মামলার তদন্ত ও লাশ উদ্ধারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত দল গতকাল রবিবার সকালে কলকাতায় যায়।
গতকাল পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ১৩ দিন পার হলেও নিহতের টুকরো টুকরো করা দেহের কোনো অংশই উদ্ধার হয়নি। খুনে ব্যবহার করা চাপাতিসহ অন্যান্য ধারালো অস্ত্রও উদ্ধার করা যায়নি। আলামতও উদ্ধারে কলকাতা পুলিশ ময়লার ভাগাড় খাল ও ডোবায় গত কয়েক দিন ধরেই তল্লাশি চালাচ্ছে।
এদিকে পুলিশ রিমান্ডে থাকা তিন আসামির জিজ্ঞাসাবাদে হত্যায় জড়িত আরও কয়েকজনের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসছে। তারা দেশে ও বিদেশে অবস্থান করছে। তথ্য যাচাই-বাছাই করে তাদের গ্রেপ্তারে ব্যবস্থা নেবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
গতকাল রবিবার রাতে কলকাতা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ আমাদের সময়কে বলেন, সঞ্জিবা গার্ডেন থেকে ঢাকায় রিমান্ডে থাকা কিলার শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহকে ভিডিওকলে যুক্ত করা হয়। কীভাবে খুন করা হয়েছে, লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে তা ভিডিওকলে সবিস্তারে দেখায় শিমুল ভূঁইয়া। খুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে আমরা পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমরা তদন্তে কী পেয়েছি তারা কী পেয়েছে, সেই তথ্য আদান-প্রদান করা হয়। এ ছাড়া কসাই জিহাদ হাওলাদারের সঙ্গে কথা বলেছি।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
জানা গেছে, গতকাল স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ৮ মিনিটে হারুন অর রশীদসহ তদন্ত দল সঞ্জিবা গার্ডেনে প্রবেশ করে। হত্যাকা-ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও তদন্ত শেষে ৫টা ১৫ মিনিটের বেরিয়ে আসেন। প্রায় এক ঘণ্টা সময় তারা ফ্ল্যাটের কোন কক্ষে খুনিরা কী ধরনের কাজ করেছে এবং কোন পথ দিয়ে বেরিয়েছে, সব বিষয় স্থানীয় পুলিশ হারুন অর রশীদসহ ডিবির তদন্ত দলকে দেখায়। সেখান থেকে তারা সিআইডির কার্যালয় কলকাতার ভবানী ভবনে যায়। ভবানী ভবনে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির রিমান্ডে রয়েছে হত্যাকা-ের অন্যতম আসামি কসাই জিহাদ হাওলাদার। তাকেও বাংলাদেশের ডিবি পুলিশ কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তদন্তকারী দল নিউটাউন থানাতেও যান। সেখানে একজন ক্যাব চালক আটক রয়েছে। এই ক্যাবে করেই এমপি আনারের লাশের টুকরো নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার কাছে মূলত লাশের টুকরো কোথায় ফেলা হয়েছে সেই বিষয়ে জানতে চায় তদন্ত দল।
খুনের কারণ হিসেবে আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, আমানুল্লাহের বোন লুচি খানমের সঙ্গে তাদের ফুফাতো ভাই ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর সদরের ডা. মিজানুর রহমান টুটুলের বিয়ে হয়। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা টুটুল ছিলেন এমপি হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিনের চাচাতো ভাই। ২০০৮ সালে পুলিশের সঙ্গে এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন টুটুল। টুটুল নিহতের ঘটনায় আনোয়ারুল আজিমের হাত রয়েছে বলে মনে করতেন আমানুল্লাহ ও শাহিন। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে আখতারুজ্জামান শাহিন খুনের সিদ্ধান্ত নিলে আমানুল্লাহকে জানান। আমানুল্লাহ বোনের জামাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে চান। পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী দুজনের শত্রু একই ব্যক্তি হওয়ায় তারা খুনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। অবশেষে তৃতীয়বারের চেষ্টায় তারা কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিবা গার্ডেনের বাসায় কৌশলে নিয়ে হত্যা করেন।
জানা গেছে, গত চার দিন ধরে কলকাতার কৃষ্ণমাটি খালে লাশের টুকরো উদ্ধারে তল্লাশি করছে পুলিশ। প্রায় ২০ কিলোমিটার লম্বা খালের বিভিন্ন জায়গায় টানা জাল, খেপলা জাল ও ডুবুরি দিয়ে তল্লাশি করা হয়েছে। গতকালও দফায় দফায় তল্লাশি করা হয়। তবে কোনো ধরনের আলামত কিংবা হাড়-মাংসের টুকরো উদ্ধার হয়নি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মরদেহের মাংস থেকে হাড় আলাদা করে খালে ফেলা হয়েছে বলে রিমান্ডে আসামিরা জানিয়েছেন। ঘটনার ১৩ দিন পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত লাশের কোনো অংশ উদ্ধার হয়নি। ফলে লাশ পচে গেছে কিংবা নদীর তলদেশে মাটির নিচেও চলে যেতে পারে। তাই জাল ফেলে লাশ উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব।
এদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ড তদন্তে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম গতকাল দুপুরে কলকাতায় পৌঁছায়। তদন্ত টিমে আরও রয়েছেন- ওয়ারী বিভাগের ডিসি মো. আঃ আহাদ ও এডিসি শাহীদুর রহমান।
সেখানে স্থানীয় গণমাধ্যমকে হারুন অর রশীদ বলেন, বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বিদেশের মাটিতে কোথাও ফেলে দেওয়া হয়েছে। ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অনুযায়ী, তদন্তকারী দলকে দুটি স্থানে পরিদর্শন করতে হয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৩৬৪ ধারায় অপহরণের মামলা করা হয়েছে। মামলা অনুযায়ী, বাংলাদেশে খুনের পরিকল্পনা হয়েছে এবং কলকাতায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পরে গুম করার জন্য এমপি আনারের মরদেহের টুকরো বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার আরও বলেন, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিমুল ভূঁইয়া এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। আমানুল্লাহ নামে তিনি ভারতে এসেছেন। তার কাছে অনেক তথ্য পেয়েছি।
তিনি বলেন, কলকাতায় ঘটনাটি ঘটেছে, দুই দেশের পুলিশ নিজেদের মধ্যে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। কলকাতা পুলিশের একটি দল ঢাকায় গিয়ে তদন্তের কাজ করেছে। কলকাতায় হত্যার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে ডিবির টিম। এখনো মরদেহ পাওয়া না যাওয়ায় কলকাতা পুলিশের সঙ্গে মরদেহ শনাক্ত কার্যক্রমেও অংশ নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন