বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে চলছে বহুতল নির্মাণ

বুড়িগঙ্গাপারে নব্য আবাসিক এলাকা

শাহজাহান মোল্লা
২৬ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে চলছে বহুতল নির্মাণ

রাজধানীতে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকাগুলোয় বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করেই দেদার চলছে বহুতল ভবন নির্মাণ। বিশেষ করে মোহাম্মদপুর ও কেরানীগঞ্জের বিশাল এলাকাজুড়ে এরই মধ্যে শত শত বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে যার কোনোটিরই নেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন। যেগুলোর নির্মাণকাজ চলছে, সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ।

এসব এলাকার বুকজুড়ে শিরার মতো প্রবাহিত ছিল রামচন্দ্রপুর খাল ছাড়াও অনেক জলাধার। ছিল কৃষিজমি। ২০১০ সালের ড্যাপে যা ‘বন্যাপ্রবণ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর একের পর এক ভবন গড়ে ওঠায় এবং সব পরিসেবা সংস্থার সংযোগ ও সেবা যোগ হওয়ায় ২০২২ সালের নতুন ড্যাপে এসব এলাকাকে আবাসিক হিসেবে দেখানো হয়। ড্যাপে আবাসিক দেখানো হলেও এখনো এসব এলাকায় ভবন নির্মাণে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র বা নকশার অনুমোদন দিচ্ছে না রাজউক। কিন্তু ভবন নির্মাণ থেমে নেই। রাজউকের বিধিমালার অপেক্ষা না করে চলছে ব্যক্তি মালিকানাধীনসহ আবাসন কোম্পানিগুলোর নির্মাণকাজ। চলছে ফ্ল্যাট বিক্রি। নির্মিত ও নির্মাণাধীন ৯০ শতাংশ ভবনের সেটব্যাক বা ইমারত নির্মাণ বিধিমালার অন্যান্য শর্ত প্রতিপালন করা হয়নি। কাজেই যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।

এদিকে মোহাম্মদপুর, বছিলা, ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা মডেল টাউন, বছিলা সিটি ডেভেলপার্স, বছিলা গার্ডেন সিটি, স্বপ্ননগর আবাসিক এলাকা, ফিউচার টাউনসহ এসব এলাকায় গড়ে ওঠা আবাসন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা জারি করেছে রাজউক। কিন্তু এ নির্দেশনা কোনো প্রতিষ্ঠানই মানছে না। যে যার মতো নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে; একের পর এক বহুতল ভবনের নির্মাণ চলছে। আর রাজউকের কর্মকাণ্ড ওই নির্দেশনা জারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

গত ১৪ মে রাজউক ভবনে এসব এলাকার হাউজিংয়ের প্রতিনিধি, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ডিপিডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী, স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নির্দেশনা ছিল, যেহেতু সরকার নির্মিত ভবন অনুমোদনের জন্য একটি নীতিমালা করছে তাই নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্মিত ভবনে কোনো প্রকার উচ্ছেদ কার্যক্রম বা নোটিশ প্রদান করবে না রাজউক এবং এসব এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন ও নতুন ভবন নির্মাণে যত দ্রুত সম্ভব ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও নকশা অনুমোদনের ব্যবস্থা করবে। রাজউক এ ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত নির্মাণাধীন ভবনের কাজ বন্ধ রাখতে হবে। এর আগে রাজউকের তরফে ডিপিডিসি বরাবর প্রেরিত পত্র অনুসারে, রাজউকের অনুমোদিত নকশা ছাড়া ভবনে নতুন করে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছিল। জানা গেছে, এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালাও চূড়ান্তপ্রায়। নীতিমালায় থাকছেÑ যেসব বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ, সেগুলো জরিমানার মাধ্যমে আত্মীকরণ করা হবে। সেখানে কেউ জলাধার বা সরকারি খাস জমি দখল করে ভবন নির্মাণ করলে সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। রাজউকের এমন নির্দেশনা সম্পর্কে এসব আবাসিক এলাকার নেতাদের অবগত হলেও তারা তা মানছেন না। এসব এলাকার বেশিরভাগ বহুতলই নির্মিত হচ্ছে যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে।

এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। শিগগিরই নীতিমালাটি চূড়ান্ত হবে। যেগুলোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে তেমন কিছু করার নেই। তবে সরকারি খাসজমি বা জলাশয় ভরাট করে ভবন গড়ে উঠলে সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। এখানে কোনো ছাড় নেই।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এখানে শত শত ভবন উঠে গেছে এবং বসবাস শুরু করেছে। আর নির্মাণাধীন রয়েছে প্রায় হাজারখানেক ভবন।

রাজউকের চৌহদ্দির মধ্যে অনুমোদনহীন এসব ভবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব আমাদের সময়কে বলেন, আমরা আর একটি ভবনও অনুমোদনহীন দেখতে চাই না। যেগুলো হয়েছে, সেগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে আত্মীকরণ করা উচিত। যা কিছু করার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করা উচিত। অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ করা হয়ে গেলে তখন সেটি ভাঙা দুরূহ হয়ে যায়। এজন্য যা কিছু করার দ্রুত করতে হবে।

রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণকাজ চলার বিষয়ে জানতে চাইলে চন্দ্রিমা মডেল টাউনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সারোয়ার খালেদ আমাদের সময়কে বলেন, সেদিন রাজউকের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তারা চিঠি দিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করতে বলবে। কিন্তু এখনো কোনো চিঠি দেয়নি। আমরা কোনো কাজ বন্ধ করার কথা বললে জমির মালিকদের সঙ্গে ঝামেলা হবে। তাই আমরা কিছু করতে পারছি না।

আপনাদের আবাসিক এলাকাতেও অনেক নির্মাণকাজ চলছে, সেগুলো কি বৈধ? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা এতো দিন রাজউকের আওতায় ছিল না। এখন রাজউকের গেজেটেড এলাকা। রাজউক যেভাবে চাইবে নীতিমালা অনুযায়ী সেভাবেই হবে। এখন অনুমোদনহীন বলা যায় না যেহেতু রাজউক গেজেটেড এলাকা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চন্দ্রিমা উদ্যানে বেশ কয়েকটি ডেভেলপার্স কোম্পানি তাদের নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখেছে। কোনো ডেভেলপার্স কোম্পানি অবৈধ কাজের বৈধতা দিতে নতুন ফন্দি করেছেন। রাজউক বরাবর অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে বলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মিলছে বিদ্যুৎ সংযোগও।

এ বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (আদাবর) আয়তুল ইমরান আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের কাছে এসে বলে রাজউক নকশা অনুমোদন দিয়েছে। আমরা কাগজ দেখেই বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছি। নকশা সঠিকভাবে অনুমোদন দিয়েছে কিনা সেটা যাচাই করার এখতিয়ার আমাদের হাতে নেই। কিছু বাড়ির নকশা দিয়েছে কিছু দেয়নি। আমরা থাকি ধোঁয়াশায়। এটার সমাধান হওয়া দরকার। আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করেই বিদ্যুৎ সংযোগের অনুমতি দিই।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী রাজউকের আওতাধীন এলাকায় নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রথমে আবেদনকারীকে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র পেলে নকশা অনুমোদন করা হয় এবং নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগে রাজউক আবেদনকারীকে অবহিত করতে হয়। কাজ শুরুর সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট ইমারত পরিদর্শকের উপস্থিতিতে নকশা অনুযায়ী কাজ শুরুর কথা। দশতলা ভবনের সাততলা করার পর ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রাপ্তির আবেদনকে ‘অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে’ বলে রাজউকের চোখে ধুলা দিতে নতুন কৌশল নিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। নির্মাণাধীন ১৩ তলা ভবনে এমন সাইনবোর্ডই দেখা গেছে। বসিলা মডেল টাউনের ৭ নম্বর রোডের ৭ নম্বর এই বাড়িটির অধিকাংশ কাজই শেষ। এখন শুধু গাঁথুনি বাকি। এ বিষয়ে ওই প্রকল্পের লজিস্টিক বিভাগের প্রতিনিধি আব্দুল আজিজ আমাদের সময়কে বলেন, সবাই তো কাজ করছে। সবার যা হবে, আমাদের ভবনেরও তা-ই হবে।

নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা নতুন শহরে যেসব প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ চলছে, সেগুলো হলোÑ আল-খায়ের ডেভেলপার্স লিমিটেড, দীনিয়া বিল্ডার্স, সারা বিল্ডার্স, ফাস্ট চয়েস ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেড (এফসিডিডিএল), সেভ বিল্ডার্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন, বিল্ডটেক, আরবান গ্রীন হাউজ ডেভেলপার্স লিমিটেড, গ্রীন প্রোপার্টি সল্যুশনস, কথাবাড়ি মরিয়ম ভিলা, আদনান ভিলা, ইমো হোমস, সম্প্রীতি ভবন প্রভৃতি।