খাবারে বাদ পড়ছে পুষ্টি
মূল্যস্ফীতির চাপে সুষম খাদ্যবঞ্চিতের সংখ্যা বাড়ছে
নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে এখন নুন ও পান্তা দুদিকেই টান পড়ছে। আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় খাবারের প্লেটে সীমিত হয়ে আসছে আমিষের পরিমাণ। ফলে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর পুষ্টি ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সবার পুষ্টিসেবার মান নিশ্চিতে দ্রুত খাদ্যদ্রব্যের দাম ক্রয়সীমার মধ্যে নিয়ে আসতেই হবে।
জাতীয় খাদ্যগ্রহণ নির্দেশিকা বলছে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২৭০ থেকে ৪৫০ গ্রাম চাল, আটা অথবা ভুট্টা গ্রহণ করা উচিত। এর সঙ্গে ৩০০ থেকে ৬০০ গ্রাম শাকসবজি এবং ১৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম মাছ, মাংস অথবা ডিম খেতে হবে। সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ৩০ থেকে ৪৫ মিলি তেল ও চর্বি এবং ৩০ থেকে ৬০ গ্রাম ডালজাতীয় খাবার থাকতে হবে। এ ছাড়া ফলমূল ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম এবং চিনি ১৫ থেকে ২৫ গ্রাম থাকতে হবে। তবে চলমান খাদ্যে মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষে এই খাদ্যতালিকা অনুসরণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পুষ্টির ঘাটতি আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
রাজধানীর একটি মেসে থাকেন একটি অনাবাসিক বিশ^বিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী টিপু সুলতান। তিনি জানান, প্রথম বর্ষে পড়াকালে প্রতিবেলার খাবারের জন্য যে টাকা ব্যয়
হতো, তিন বছর পর সেই একই পরিমাণ খাবারের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ১৫ থেকে ১৭ টাকা। ফলে প্রতিদিন দুই বেলা খাবারের জন্য মাস শেষে তার অতিরিক্ত ব্যয় বেড়েছে প্রায় এক হাজার টাকা। খরচের বোঝা কমাতে টিপু সুলতানদের মেসে কমানো হয়েছে আমিষের পরিমাণ। তিনি বলেন, ‘কম খরচে বাড়তি হিসেবে মাঝে মধ্যে ডিম খেতাম। কিন্তু এখন ডিমের দামও তো সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই) প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যে খাদ্যপণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে, সেই একই পণ্য চলতি বছরের এপ্রিলে কিনতে খরচ করতে হয়েছে ১১০ টাকা ২২ পয়সা। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন সীমিত আয়ের মানুষ।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সন্তানের পড়ালেখার কারণে গ্রাম থেকে স্ত্রী ও সন্তানকে ঢাকায় এনেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক সেলিম মিয়া। আবাসন খরচ ও সন্তানের পড়ালেখার ব্যয় মেটানোর পর তাদের খাবারে টান পড়ছে। ফলে যে উদ্দেশ্যে সন্তানকে শহরে এনেছেন, চলমান বাস্তবতায় তা কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে সেলিম মিয়ার।
বৈশি^ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য বলছে, যেসব শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং অন্য রোগের সংক্রমণের ঝুঁঁকিও বেশি। ফলে প্রায়শই তারা কোনো কিছুতে বেশি মনোযোগ দিতে পারে না। এ কারণে তাদের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং টুফটস ইউনিভার্সিটির ২০২১ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের ১২ কোটি ৫২ লাখ মানুষ পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ করতে পারছেন না। যা মোট জনসংখ্যার ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ। ওই রিপোর্টে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়, ২০২৪ সাল নাগাদ এই সংখ্যা আরও বিশাল হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অপুষ্টি আগেও ছিল। তবে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম এবং আর্থসামাজিক নানা বৈষম্যের কারণে তার মাত্রা বাড়ছে। এক্ষেত্রে বিকল্প বা কম মূল্যের সুষম খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন পুষ্টিবিদরা।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) প্রথম বাংলাদেশি নির্বাহী পরিচালক ও পুষ্টিবিদ ড. তাহমিদ আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বহু দেশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির সমস্যায় ভুগছে। আমাদের এখন বিকল্প সুষম খাদ্যগ্রহণে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। যে পরিবারের সবাই প্রতিদিন একটা ডিম খেত, তারা যেন পুরোপুরি খাওয়া বন্ধ না করে। প্রতিদিন অর্ধেক ডিম খেলেও পুষ্টির ঘাটতি কিছুটা পূরণ করা সম্ভব। সেই সঙ্গে খাদ্যতালিকায় ডাল-সবজি থাকতে হবে। যেহেতু এগুলোর দামও বাড়ছে, তাই কম মূল্যের সূষম খাবারগুলো মিক্স করে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।’
অপুষ্টির শিকার নারী ও শিশু
ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের এক যৌথ জরিপ বলছে, অপুষ্টির কারণে দেশের ৫ বছরের কম বয়সী ২৬ শতাংশ বা ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। গত বছরের মে মাসে প্রকাশিত ‘শিশু অপুষ্টির মাত্রা ও প্রবণতা’ শীর্ষক ওই বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে অন্তত একটি ক্ষেত্রে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি বাড়ছে। দেশে আগের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ওজনের শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। পুষ্টিবিদরা বলছেন, একটি শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সুষম খাবার। একই সঙ্গে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে গর্ভাবস্থায় মায়ের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক দুই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে উদ্বেগ
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
পুষ্টি নিয়ে আন্তর্জাতিক দুটি লক্ষ্যমাত্রা আছে। একটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেমব্লিতে ২০১২ সালে নেওয়া, অন্যটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি), যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে। এসডিজির ২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় ওজন কম নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা কমানো, শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ানো এবং অপুষ্টিতে ভুগছে, এমন শিশুর হার কমানোর প্রতিশ্রুতি আছে। তবে মূল্যস্ফীতির কারণে সৃষ্ট পুষ্টিঘাটতি সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।