নজরুলের জাগরণী চেতনায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
২৪ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
নজরুলের জাগরণী চেতনায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

জাগরণী চেতনা জনজীবনে কিংবা জাতীয় জীবনে এক মহামূল্যবান সম্পদ। সময়মতো জাগরণ না ঘটাতে পারলে পরাধীন জাতির যেমন স্বাধীনতা অর্জন কঠিন হয়ে যায়, তেমনি অর্জিত স্বাধীনতাও জাগরণী চেতনার অভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। রুশ বিপ্লবের সাফল্যের পেছনে কিংবা ফরাসি বিপ্লবের সাফল্যের পেছনে মূল শক্তি ছিল সময়মতো চেতনার জাগরণ ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন। সময় পার হয়ে গেলে তখন জাগরণী চেতনার শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ইউরোপীয় রেনেসাঁর শক্তির মূলে ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার জাগরণ। বঙ্গবন্ধুর আগে বাঙালিকে তার কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার চেতনায় জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছে অনেকেই। কিন্তু একজন উপযুক্ত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার অভাবে বাঙালির জাগরণ অপূর্ণ ও অপুষ্ট জাগরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ইতিহাসে। নজরুলের স্বদেশপ্রেমমূলক জাগরণী চেতনার স্ফুলিঙ্গে জ্বলে উঠেছিল বাঙালির হাজার বছরের কাক্সিক্ষত মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে ছিল এক অনন্য যুগল সম্পর্ক। দুজনই বাংলা মায়ের অপরাজেয় বীর, দুজনই ট্র্যাজেডির নায়ক। তারা উভয়েই প্রবল জাতীয়তাবাদী। তাদের এই জাতীয়তাবাদের শেকড় এক জায়গায়ই প্রোথিত আর এই জাতীয়তাবাদ মানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বিবিসির জরিপে এই দুই বাঙালির একজন দখল করে আছেন সর্বকালের সেরা বাঙালির এক নম্বর স্থানটি আর অন্যজন দখল করেছেন তিন নম্বর স্থানটি। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মপরিক্রমায় এ দুই বিপ্লবী হয়ে আছেন ইতিহাস।

উনিশশ কুড়ি সালের সতেরো মার্চ যখন টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের জন্ম হয়, তখন নজরুল মার্চ-এপ্রিলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে যুদ্ধের শেষের দিকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে কর্মরত। যুদ্ধফেরত হয়ে নজরুল জুলাইয়ের বারো তারিখে শেরেবাংলার সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন বন্ধু মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে। নজরুল যে সময় কলকাতায় হয়ে উঠেছেন সবার নয়নমনি, তখন মুজিব তার নয়নজোড়া নিয়ে পড়েছেন বিপদে। কলকাতার বিখ্যাত চক্ষু সার্জন ডা. টি আহমদের কাছে যখন মুজিব চিকিৎসা নেন, তখন নজরুলের গানে-কবিতায় বুঁদ হয়ে আছে কলকাতা। গ্লুকোমার চাপে উনিশশ ছত্রিশ সাল থেকে চশমা পরা মুজিব প্রথম কবি কাজী নজরুলকে দেখতে পান সশরীরে উনিশশ একচল্লিশ সালে ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা সম্মেলনে। সেই সম্মেলনে অন্যান্য শিক্ষাবিদের সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন কবি কাজী নজরুল। পুলিশ সে সভায় একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করার কারণে সভা হলো না, হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে কনফারেন্স হলো আর তাতে গান করলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এভাবেই প্রথম সশরীরে সাক্ষাৎ হয় মুজিব ও নজরুলের। এর পর উনিশশ বায়ান্ন সালের সাতাশ ফেব্রুয়ারি তারিখে জেল থেকে মুক্তি পান মুজিব। মে মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে লাহোর হয়ে করাচি যান মুজিব। উদ্দেশ্য গুরু শহীদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। করাচিতে শহীদ সাহেবের সঙ্গে গাড়িতে চড়াকালীন পেছনে বসা শহীদ সাহেবের পেশাগত বন্ধু অ্যাডভোকেট সাহেবরা মুজিবের কাছে বাংলা ভাষার আন্দোলন প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চেয়েছিলেন। মুজিব তাদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্যবাদী’সহ আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতার দু-একটার কয়েক লাইন শোনালেন, যা শহীদ সাহেব তৎক্ষণাৎ ইংরেজি তর্জমা করে বুঝিয়ে দেন। এ থেকে বোঝা যায়, মুজিবের কবিতা পাঠের অভ্যাস ছিল এবং নজরুলের কবিতা তার নিয়মিত চর্চায় ছিল। আরও বুঝতে অসুবিধা হয় না যখন জানা যায়, মুজিবের ছোটবেলা থেকেই তাদের বাড়িতে ‘সওগাত’, ‘দৈনিক আজাদ’, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকাগুলো রাখা হতো। অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই মুজিব এসব পত্রিকা মারফত নজরুলের লেখা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। নজরুল ‘বাংলাদেশ’ কথাটি কবিতায় ব্যবহার করেন উনিশশ একত্রিশ সালে। তিনি লেখেন, ‘নমঃ নমঃ নমো/ বাঙলাদেশ মম/ চির মনোরম/ চির মধুর।’ আর বঙ্গবন্ধু সেই কবিতাকে মর্মে গেঁথে রেখে উনিশশ সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ সাল থেকেই ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি চেতনায় ধারণ করেন। এই শব্দটি তিনি উনিশশ ঊনসত্তরের পাঁচ ডিসেম্বর তারিখে মনের গভীর থেকে মুক্তি দেন। তিনি পূর্ববাংলাকে নিয়ে গঠিত দেশের নাম ঘোষণা করেন ‘বাংলাদেশ’। ব্রিটিশ আমলে মাদারীপুরের বিপ্লবী অধ্যক্ষ পূর্ণ চন্দ্র দাস তখন তরুণ বিপ্লবী শেখ মুজিবের প্রেরণা। এক সময় ব্রিটিশের হাতে বিপ্লবী পূর্ণ চন্দ্র ধৃত হন এবং পরে কারামুক্ত হন। নজরুল পূর্ণ চন্দ্রের কারামুক্তিতে কালিপদ’র অনুরোধে উনিশশ বাইশ সালে বহরমপুর জেলে বসে লেখেন কবিতা, ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’। কবিতাটি যাতে কর্তৃপক্ষের চোখে না পড়ে, সেজন্য পাউরুটির ভেতর কাগজটা ঢুকিয়ে তিনি পাচার করেন কালিপদর কাছে। কালিপদ কবিতাটি মুখস্থ করে জেল থেকে বের হয়ে দ্রুত হুবহু দুই কপি লিখে ফেলেন। পরে কবিতাটি বিপ্লবী পূর্ণ চন্দ্র দাসের কারামুক্তির সংবর্ধনা উপলক্ষে কালিপদ কর্তৃক পঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই কবিতার চরণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ গ্রহণ করেন। ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতায় কবি বলেছিলেন : ‘জয় বাঙলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ।’ সেই রণধ্বনি দিয়েই আমরা কাবু করেছি একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের। বাংলাদেশের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রচার হয় উনিশশ একাত্তরের পঁচিশে মে, এগারো জ্যৈষ্ঠ তেরশ আটাত্তর বঙ্গাব্দে। অর্থাৎ এটি ছিল নজরুলের একাত্তরতম জন্মদিন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ক্ষুদ্র মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব পাস হয় নজরুলকে বাংলাদেশে আনার। নজরুলের পরিবার ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে নজরুলকে শেখ মুজিব বাংলাদেশে আনেন উনিশশ বাহাত্তর সালের চব্বিশে মে এবং নাগরিকত্ব প্রদান করেন। নজরুলকে আনতে তিনি তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী মতিউর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুস্তফা সারোয়ারকে কলকাতা পাঠান এবং নিজে ‘হে কবি...’ বলে কবি ও কবির পরিবারকে বাংলাদেশে আসার অনুরোধ সংবলিত চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। দুই দফায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে সম্মতি আদায় করেন। পরবর্তী সময়ে একেবারে রেখে দেওয়ার জন্য ভাসানীর দাবিতে সম্মত হয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে আবারও টেলিফোন করেন।

তিনি নজরুলকে আমাদের জাতীয় কবি সম্মানে ভূষিত করেন এবং তাকে কবিভবনে রাখার ব্যবস্থা করেন। কবি ভবন বর্তমানে নজরুল ইনস্টিটিউট, যার ঠিকানা বাড়ি নং তিনশ তিরিশ, সড়ক নং পনেরো, ভাষাসৈনিক বিচারপতি আব্দুর রহমান সড়ক, ধানমণ্ডি, ঢাকা। মুজিব তাকে নিয়মিত দেখতে যেতেন, খোঁজখবর রাখতেন। জাতির পিতা তার বিছানায় না বসে তার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে কবির সঙ্গে কথা বলেন ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। প্রথম যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে কবির সঙ্গে জাতির পিতার দেখা হলো, জাতির পিতা বিশাল এক ফুলের তোড়া কবিকে উপহার দেন। কবি বঙ্গবন্ধুকে দেখে মুখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। বাংলা মায়ের এই দুই বিপ্লবীর মিলনপর্বে সেদিন এক অভূপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। বঙ্গবন্ধু নিজে কবি নজরুলের রচিত ‘চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানটিকে আমাদের রণসংগীত হিসেবে চয়ন করেন।

চুরুলিয়ার লাল ঊষর মাটিতে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা নজরুলের চেতনায় যেমন বেজে উঠেছিল সাম্যবাদের গান, তেমনি বঙ্গবন্ধুর প্রাণেও দোলা দিয়ে যায় শোষিতদের প্রতি অবিরাম সহমর্মিতা। একজন লাঞ্ছিত হওয়া কুলির দৃশ্য যেমন নজরুলকে আত্মার ভেতরে স্পর্শ করে তেমনি বঙ্গবন্ধুকেও ছুঁয়ে যায় ধান কাটার শ্রমিক তথা দাওয়ালদের কষ্ট। নজরুল যেমন উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল না থামা অবধি নিজের লড়াইয়ের সমাপ্তি না টানার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুও আলজিয়ার্সের জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে শোষিতের পক্ষে নিজের আজীবন সমর্থন দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। নজরুল বাঙালির মধ্যে শেকল ভাঙার যে বোধের বীজ উপ্ত করে গেছেন, বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় দফার হাতিয়ার হেনে সেই চেতনায় নিজের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। নজরুল যে বাংলাদেশের জন্য আকুলি-বিকুলি করেছেন, বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে নজরুলের সেই বাংলাদেশকে অবয়ব দান করেছেন। এ বাংলাদেশ মোল্লার বাংলাদেশ নয়, এ বাংলাদেশ পুরুতের বাংলাদেশ নয়Ñ এ হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ। নজরুল যে বৈষম্য দূর করে কৃষক-শ্রমিকের বাংলাদেশের কথা ভেবেছেন বঙ্গবন্ধু সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দ্বিতীয় বিপ্লবের বীজ বপন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই চেতনার বীজ যদি বিকশিত হতে পারত, তবে আজ বাংলাদেশ হয়ে উঠত এ পৃথিবীর এক অগ্রগণ্য শক্তি। যদিও আজ তারই উত্তরাধিকারের হাতে আমরা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠেছি, তবু এ উন্নয়নের শতফুল ফুটে উঠতে পারত আরও আগেই, যদি জাতির পিতাকে আমরা অকালে না হারাতাম।

বঙ্গবন্ধু এবং নজরুল আমাদের জাতীয় জীবনে দুই স্তম্ভ। একজন স্বাধীনতার মহান স্থপতি আর অন্যজন স্বাধীনতার জাগরণ আনা বিপ্লবী। একজন কথায়, কবিতায় ও গানে আমাদের স্বাধীনতার চেতনা উসকে দিয়েছেন, আরেকজন আমাদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বাস্তবে রূপ দিয়ে মুক্ত করেছেন। উভয়েই যেমন সাম্যবাদী, তেমনি অসাম্প্রদায়িক এবং তেমনি নিপীড়িত শোষিতের কণ্ঠস্বর। একজন যেমন অগ্নিবীণায় ব্রিটিশকে পর্যুদস্ত করে তুলেছেন, তেমনি অন্যজন সাত মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ দিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন বিশ্বকে।

বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল শাসকের তখ্তে যেমন আঘাত করেছেন, তেমনি ছয় দফার মোক্ষম হাতিয়ারে বঙ্গবন্ধু কাঁপিয়ে দিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভিত। পিকস্ ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে নজরুল যেমন অকালে জীবন্মৃত হয়েছিলেন, তেমনি ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুও অকালে জীবন হারান। আগস্ট এই মহান দুই বিপ্লবীকে, দুই সাম্যবাদীকে চিরঘুম পাড়িয়ে রেখেছে বাংলার মায়ার্দ্র মাটিতে। সময় স্বপ্ন দেখেছিল এবং প্রতীক্ষায় ছিল এক মুক্তিদাতা মহানায়কের। মহাতাপস কবি সেই স্বপ্নের চেতনায় বাঙালির মধ্যে জাগরণ তৈরি করেন। বাঙালির মহানায়ক সেই জাগরণকে আরও শাণিত করে, আরও শক্তি সঞ্চার করে ঘটিয়ে তোলেন শৃঙ্খল মুক্তির বিপ্লব। তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে নজরুলের জাগরণী চেতনার অবদান অনস্বীকার্য ও অবিস্মরণীয়। বঙ্গবন্ধু সেই চেতনাকে নেতৃত্ব দিয়ে এনে দিয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা। এই দুই মহান জাগরণমুখ্য বিপ্লবীর প্রতি অনন্ত শ্রদ্ধা।