মুক্তিযুদ্ধ ধারার উপন্যাস পর্বতের মূষিক প্রসব

স র কা র আ ব দু ল মা ন্না ন
০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শেয়ার :
মুক্তিযুদ্ধ ধারার উপন্যাস পর্বতের মূষিক প্রসব

সাহিত্য-শিল্পের জগতে উপন্যাস একেবারেই ভিন্ন জাতের রচনা। মানবজীবনকে ধারণ করার জন্য এর চেয়ে ভালো শিল্পমাধ্যম আর হতে পারে না। গল্প, কবিতা, নাটক কিংবা অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমের অবয়বগত এবং আকার-আকৃতিগত কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। উপন্যাস এই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। কারণ উপন্যাস সবকিছুকে ধারণ করতে পারে। উপন্যাস কবিতা ধারণ করতে পারে, গান-গল্প-নাটক এবং অন্য যে কোনো শিল্প অনায়াসে নিজের গর্ভে ধারণ করতে পারে। জীবনের যে বিস্তৃত পরিসর- তাকে অবলীলায় ধারণ করতে পারে উপন্যাস। ফলে কোনো কোনো উপন্যাস মহাকাব্যিক রূপ পরিগ্রহ করে। তাতে উপন্যাসের অঙ্গহানি হয় না, উপন্যাস তার স্বভাব থেকে বিচ্যুতও হয় না। উপন্যাসের এই সর্বগ্রাসী স্বভাবের জন্য জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোকে উপন্যাস খুব সহজে, স্বাচ্ছন্দ্যে এবং সচ্ছলভাবে গ্রহণ করতে পারে। উপন্যাসের আরেকটি স্বভাব হলো, জীবন ও জগতের অনুপুঙ্খ অবয়বগুলো তীব্র-তীক্ষèভাবে তুলে আনার শক্তি। এই শক্তি অন্য কোনো সাহিত্য-শাখার নেই। কেননা লেখককে উপন্যাসের অবয়বগত সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে হয় না। একশ পৃষ্ঠার উপন্যাস থেকে শুরু করে এক হাজার পৃষ্ঠার উপন্যাসের উদাহরণ বিরল নয়। খবড় ঞড়ষংঃড়ু-এর ডধৎ ধহফ চবধপব প্রায় ১৪৪০ পৃষ্ঠার উপন্যাস। ঠরপঃড়ৎ ঐঁমড়-এর খবং গরংল্কৎধনষবং ১৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস। তেমনিভাবে উধারফ ঋড়ংঃবৎ-এর ডধষষধপব ওহভরহরঃব ঔবংঃ, অুহ জধহফ-এর অঃষধং ঝযৎঁমমবফ, ঋুড়ফড়ৎ উড়ংঃড়বাংশু-এর ঞযব ইৎড়ঃযবৎং কধৎধসধুড়া, ঠরশৎধস ঝবঃয-এর অ ঝঁরঃধনষব ইড়ু, ঐবৎসধহ ডড়ঁশ-এর ঞযব ডরহফং ড়ভ ডধৎ কিংবা ঐধৎঁশর গঁৎধশধসর-এর ১ছ৮৪ প্রভৃতি উপন্যাসের কথা বলা যায়। প্রতিটি উপন্যাসের পরিধি এক হাজার পৃষ্ঠার ওপরে। আর খুব ছোট পরিসরের উপন্যাসও আছে। ঋৎধহু কধভশধ-এর ঞযব গবঃধসড়ৎঢ়যড়ংরং পঞ্চান্ন পৃষ্ঠার উপন্যাস। ঔড়ংবঢ়য ঈড়হৎধফ-এর ঐবধৎঃ ড়ভ উধৎশহবংং সাতাত্তর পৃষ্ঠার উপন্যাস। এবড়ৎমব ঙৎবিষষ-এর অহরসধষ ঋধৎস একশ বারো পৃষ্ঠার উপন্যাস।

উপন্যাস ছোট বা বড়, সেটা অনেক সময় বিবেচ্য বিষয় নয়। ছোট উপন্যাস ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি নিশ্চয়ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসের উদাহরণ। এই উপন্যাসে একজন ব্যক্তির কিছু মুহূর্তের জীবনাখ্যান যেমন অবলীলায় উপস্থাপিত হয়েছে এবং পৃথিবীবিখ্যাত উপন্যাস হিসেবে অনন্য হয়ে আছে। কিন্তু ছোট অবয়বের উপন্যাসের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিপুল এক জীবন ধারণ করা সম্ভব নাও হতে পারে। একটি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কেও মহাকাব্যিক অবয়বে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন বৃহৎ পরিসরের উপন্যাস। জাতিগত ঘটনার অসীম সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগিয়ে জীবন ও জগতের বহুতর অধ্যায়কে উপস্থাপন করে বহু পৃষ্ঠার কালজয়ী উপন্যাস অনেক রচিত হয়েছে।

বাঙালি জাতির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। দেশের মানুষও ঐতিহাসিকভাবে শান্তি ও সুস্থির মানসিকতার কারণে ওইসব শাসন-শোষণ-অত্যাচার-অবিচার-নিপীড়ন-নির্যাতন-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করে এসেছে শত-সহস্র বছর ধরে। কিন্তু বিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই এ দেশের মানুষ আস্তে আস্তে জেগে উঠতে শেখে এবং তাদের সেই জেগে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে ভাষাভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির দর্শনকে চমৎকারভাবে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার বিপুল আত্মত্যাগী নেতৃত্বে এক সময় এ দেশের মানুষ তাদের পরাধীনতার স্বরূপ অনুধাবন করতে পারেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অসংখ্য সহযোদ্ধার নেতৃত্বে এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জয়ী হয়। বিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে বাঙালি জাতি প্রথম স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করে। কিন্তু তার পেছনে আত্মত্যাগ ও আত্মবিসর্জনের যে ইতিহাস রচিত হয়েছে, তার পরিধি অপরিসীম। এই রক্তঝরা অধ্যায় নিয়ে বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে লেখালেখি হয়নি। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমগুলোতেও মুক্তিযুদ্ধের এই সময়টিকে নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন আমাদের শিল্পীরা। এই ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হলো উপন্যাস। যারা কথাসাহিত্যিক, গল্প-উপন্যাস রচনা করেন, তাদের প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন এবং এই ধারাটি আজ পর্যন্ত বিচিত্র বাঁক ও মোড় নিয়ে অব্যাহত আছে। এই ধারার উল্লেখযোগ্য কথাশিল্পী ও তাদের উপন্যাসগুলো হলো : আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) রাইফেল রুটি আওরাত (১৯৭৩); শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক (১৯৭৩) এবং জলাঙ্গী (১৯৭৬); শওকত আলীর (১৯৩৬-২০১৮) যাত্রা (১৯৭৬); রশীদ হায়দারের (১৯৪১-২০২০) খাঁচায় (১৯৭৫), অন্ধ কথামালা (১৯৮১) ও নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য (১৯৮২); মাহমুদুল হকের (১৯৪১-২০১৮) জীবন আমার বোন (১৯৭৬), খেলাঘর; সেলিনা হোসেনের (১৯৪৭) হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) ও যুদ্ধ (২০০৫); রাবেয়া খাতুনের (১৯৩৫-২০২১) মেঘের পরে মেঘ, হানিফের ঘোড়া, ফেরারী সূর্য (১৯৭৪) ও ঘাতক রাত্রি; আমজাদ হোসেনের (১৯৪২-২০১৮) অবেলায় অসময় (১৯৭৫); রশীদ করিমের (১৯২৫-২০১১) আমার যত গ্লানি (১৯৭৩); মাহবুব তালুকদারের (১৯৪২-২০২২) অবতার (১৯৭৩); ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের (১৯৪৫) বন্দি দিন বন্দি রাত্রি (১৯৭৬); আহমদ ছফার (১৯৪৩-২০০১) ওঙ্কার (১৯৭৫) ও অলাতচক্র (১৯৯০); হুমায়ূন আহমেদের (১৯৪৮-২০১২) শ্যামল ছায়া (১৯৭৩), নির্বাসন (১৯৮৩), সৌরভ (১৯৮৪), ১৯৭১ (১৯৮৬), আগুনের পরশমণি (১৯৮৮), অনিল বাগচীর একদিন (১৯৯২) এবং জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প (২০০৬); সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) নীল দংশন (১৯৮১), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১), দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১৯৮৯-৯০), এক যুবকের ছায়াপাত (১৯৮৭) এবং ত্রাহি (১৯৮৮); হারুণ হাবীবের (১৯৪৮) প্রিয়যোদ্ধা, প্রিয়তম (১৯৮২); হরিপদ দত্তের (১৯৪৭) অক্ষর (প্রথম খণ্ড ১৯৮৯, দ্বিতয়ি খণ্ড ১৯৯১), ঈশানে অগ্নিদাহ (১৯৮৬) ও অন্ধকূপে জন্মোৎসব (১৯৮৭); আবু জাফর শামসুদ্দীনের (১৯১১-১৯৮৮) দেয়াল (১৯৮৬); ইমদাদুল হক মিলনের (১৯৫৫) মহাযুদ্ধ, ঘেরাও, বালকের অভিযান, কালো ঘোড়া, দ্বিতীয় পর্বের শুরু এবং রাজাকারতন্ত্র; মঈনুল আহসান সাবেরের (১৯৫৮) পাথর সময়, ফিরে আসা (১৯৮৯), সতের বছর পর (১৯৯১), কবেজ লেঠেল; শহীদুল জহীরের (১৯৫৩-২০০৮) জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮); আনিসুল হকের (১৯৬৫) মা (২০০২); শাহীন আখতারের (১৯৬২) তালাশ (২০০৫); আল মাহমুদের (১৯৩৬-২০১৯) উপমহাদেশ; মঞ্জু সরকারের (১৯৫৩) তমস (১৯৮৪) ও প্রতিমা উপাখ্যান, মহীবুল আজিজের (১৯৬২) বাড়ব (২০১৪) ও যোদ্ধাজোড় (২০১৪); মনি হায়দারের (১৯৬৮) ভাগীরথী ইত্যাদি।

ওপরে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের একটি খণ্ডিত তালিকা প্রদান করা হলো। এ তালিকায় যেসব উপন্যাস স্থান পেয়েছে, তার সবগুলো আমাদের সবার পড়া নেই নিশ্চয়ই। কিন্তু যে কয়েকটি পড়া আছে, সেখান থেকে স্পষ্টতই একটি ধারণা জন্মে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর উপন্যাস লেখা হয়েছে এবং সেই উপন্যাসের অধিকাংশই শিল্পমানসম্মত নয়। বৃহৎ যে জীবনাকাক্সক্ষা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে রক্তাক্ত স্বরূপে উন্মোচিত হয়েছিল, তার খুব একটা পরিচয় কোনো উপন্যাসেই মহাকাব্যিক অবয়বে ধরা দেয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুয়েকটি চরিত্রের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র মাত্রা ও মাত্রান্তরের চালচিত্রের পরিচয় মুদ্রিত হয়েছে মাত্র। ফলে অধিকাংশ উপন্যাসের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে জীবন পরিলক্ষিত হয়, তা খণ্ডিত, ছেঁড়াফাড়া, টুকরো টুকরো ও ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এসব উপন্যাসের ভেতর দিয়ে সমগ্রতার আস্বাদ লাভ করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই উপন্যাসের ধারা প্রবহমান আছে। তার মধ্যে নানারকম বিবর্তন, বাঁক ও মোড় বদল ঘটেছে।

এই সময়ে অনেক তরুণ কথাসাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এই পুরো যাত্রাপথে সারল্যের উদ্বেলতা অতিক্রম করা যায়নি কখনো। ফলে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোতে যুদ্ধ এসেছে; আপনজন হারানোর হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণা এসেছে; হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্তাকার ঘাতক শ্রেণির নানারকম হিংস্রতার পরিচয় এসেছে।

যুদ্ধোত্তর কালের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় এসেছে উপন্যাসগুলোয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর কোনো ক্যানভাসে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্রতায় সমৃদ্ধ কোনো অবয়ব রচিত হয়নি। হয়তো আমাদের আরও বহুকাল ওয়ার অ্যান্ড পিস বা ব্রাদার কারামাজ প্রকৃতির বৃহত্তর কলেবরের অফুরন্ত এক জীবন জিজ্ঞাসাসংবলিত উপন্যাসের অপেক্ষায় থাকতে হবে। া