উপন্যাসে নারীচরিত্র চিত্রণ
উনিশ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগে ইংরেজ ঔপন্যাসিক থমাস হার্ডি সৃষ্টি করেছিলেন অমর এক চরিত্র টেস, যে ছিল তার কালজয়ী উপন্যাস ‘টেস অব দা ডা’ভাভিলস’-এর ট্র্যাজিক নায়িকা। বিশ শতকে বাংলাদেশের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক, মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শহীদুল্লা কায়সার তার ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসে সৃষ্টি করলেন আরেক দ্রোহের চরিত্র হুরমতি। এ শতকের দ্বিতীয় দশকে সব্যসাচী লেখক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর সৃষ্টি করলেন হানুফা চরিত্র। পাঠক, সমালোচক মহলে সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘বিলডাকিনি’তে হানুফা নামে কেন্দ্রীয় চরিত্রের উত্থান-পতন ও তার ব্যক্তি সংকটের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এখানে হানুফা, হুরমতি কিংবা টেস চরিত্রগুলোয় পাঠক নারীজীবনের সংগ্রাম, ভয়াবহ পরিণতি ও দ্রোহের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
সাহিত্য বা শিল্পে কোনো সৃষ্টি কখনো পুরনো হয় না। সব সৃজনশীল, কালজয়ী সৃষ্টি চিরায়ত শিল্প কিংবা চিরনতুন বলা যায়। স্থান-কালের সীমা পেরিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আফ্রিকা, ইউরোপ, আরব দেশ পেরিয়ে এ ভারতীয় উপমহাদেশে নারীজীবনের যে উত্থান-পতন, সংগ্রাম, নিয়তি, ধর্মীয়-সামাজিক সংকট প্রভৃতি একই বৃন্তের ঘটনা বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয়। সঙ্গতকারণে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিকরা নিজস্ব লেখনী দিয়ে সেই সাদৃশ্যপূর্ণ জীবনচিত্র তুলে ধরেন। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ আর নব্য বিশ্বয়ানের এ যুগেও বাংলাদেশের সাবেক সমতট অঞ্চলের নিম্নবর্গের এক নারী চরিত্রের সঙ্গে দেশ-বিদেশের কালজয়ী অনেক নারী চরিত্রের সাদৃশ্য পাওয়া যায়, হয়তো ভবিষ্যতেও সাহিত্য-সৃষ্ট চরিত্রের মাঝে পাওয়া যেতে পারে।
ডাকিনি নাম উচ্চারণমাত্রই পাঠককুল বুঝতে পারেন এক অশুভ আত্মা, শক্তির উত্থান, যা কেবল মানুষের ক্ষতিই করতে পারে। গ্রামের নাম বিলডাকিনি। ঔপন্যাসিক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর তার উপন্যাসের নামও দেন বিলডাকিনি। নেতিবাচক ডাকিনি শব্দটি যেন কেন্দ্রীয় হানুফা চরিত্রের ওপর সজ্ঞানে আরোপ করেছেন লেখক নিজেই, যেমনটি করেছেন ওই গ্রামের মানুষ তাকে অসতী, বেপর্দা নারী আখ্যা দিয়ে। তাই গ্রামের নামে উপন্যাসের নামকরণ এবং তার যথার্থতা যাচাইয়ে শিল্পসম্মত মান পাঠক খ্ুঁজে পায়।
ঔপন্যাসিক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর উপন্যাসের শুরুতে এক ঘোর অন্ধকার দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। এটির শুরু হানুফা নামে ব্যথাতুর নারীর যন্ত্রণা দিয়েই। ওই অন্ধকার মনুষ্য সমাজসৃষ্ট অন্ধকার, এক আঁধারকবলিত জনপদের অন্ধকারের স্বরূপ। ‘পায়ের কাঁটা যন্ত্রণা দিচ্ছে’- এ বাক্য দিয়েই উপন্যাসের শুরু। এক কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অন্ধকারে নিমজ্জিত ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিভিত্তিক গ্রামের বুকে প্রকারান্তে ওই কাঁটা বিদ্ধ হয়েছে। এখানে মানুষ অর্থ, শক্তি আর অশুভ বুদ্ধির লীলা দেখায়, বড়রা ছোটদের নির্যাতন করছে, আইন-বিচারব্যবস্থাকে বড়রা বৃদ্ধাঙ্গুলির মধ্যে রেখে শাসন করছে সমাজের শক্তিহীন, শ্যাওলার মতো ভেসে থাকা নিম্নবর্গের মানুষদের। আকবর, নোকার মাঝি, হানুফারা আজীবন মণ্ডলদের মতো হায়েনাদের হাতে যেমন ইচ্ছে খেলার পুতুল, যেটি জৈবিক, আর্থিক কিংবা অনৈতিক বলা যেতে পারে।
উনিশ শতকে ভিক্টোরিয়ান কালের ষোড়শী টেস কেবল ভালোবেসে নয়, পরম আরাধ্য দেবতারূপী পুরুষ অ্যালেককে সর্বস্ব দান করেছিল ‘পতি পরম দেবতা’ ভেবে। না, সে পায়নি পতিকে, ভালোবাসাকে, সাজানো ঘর-সংসারকে। পেয়েছে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, প্রতারণা, হারিয়েছে দৈহিক পূত-পবিত্রতা। এর পর টেসের জীবনে আবার এলো ফেরেশতাতুল্য আরেক পুরুষ অ্যাঞ্জেল। সেখানেও ঠাঁই হয়নি টেসের, হয়েছে প্রতারিত, হয়েছে পরিত্যক্ত। ইংরেজ ঔপন্যাসিক থমাস হার্ডি এমন চরিত্র চিত্রণ করে উনিশ শতকের ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় নারীদের সংগ্রাম, শ্রেণি প্রথা, সামাজিক-পারিবারিক মর্যাদা, অবস্থান নিয়ে সৃষ্টি করলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘টেস অব দা ডা’ভাভিলস।’ ষোড়শী টেস বাবা-মা আর ছোট বোনের কথা, পরিবারের অভাব-অনটনের কথা চিন্তা করে কর্মের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। বিধি সইল না। এ সমাজের পুরুষদের হাতে কুরে কুরে নিষ্পেষিত হলো, নিঃশেষ হলো, একদিন গলায় ফাঁসের দড়িও পরতে হলো টেসকে। অন্যদিকে শহীদ শহীদুল্লা কায়সারের অমর সৃষ্টি সংশপ্তক উপন্যাসের হুরমতি কেন্দ্রীয় চরিত্র না হলেও উপন্যাসের আরম্ভ হয়েছে তার শাস্তির মধ্য দিয়ে। কথিত বিশুদ্ধ সমাজ এক নারীর কপাল তপ্ত পয়সা দিয়ে দাগিয়ে পতিতা আখ্যা দিয়ে ছুড়ে দিচ্ছে পথে, সমাজচ্যুত করে। এ চরিত্রকে কেন্দ্র করে জৈবিক, আর্থ-সামাজিক, নিচোল মানবিক সংঘাতপূর্ণ ঘটনামুখ্য নাটকীয়, গল্পরস ছড়ানো হয়েছে সংশপ্তক উপন্যাসে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত, জেদি, বিদ্রোহিনী, পাল্টা প্রতিশোধ স্পৃহা হুরমতির, ঈর্ষা, লোভ, হিংসার বিষচক্রে রূপবতী যৌবনের সর্বনাশা আগুনে বিষিয়ে দগ্ধে পুঁজে দিন কাটে হুরমতির। ভদ্রবেশী সমাজপতি রমজানের অনৈতিক সম্ভোগ চেষ্টার জন্য কান কেটে নিয়ে হুরমতি তার অপমান, যন্ত্রণা ও কলঙ্কের প্রতিশোধ নেয়। নারীমাংস শিকারি রমজান চিরকালের জন্য আখ্যায়িত হয় কানকাটা রমজান নামে, কলঙ্ক মাথায় নিয়ে। তার পর অতিবাহিত হয় দীর্ঘ বছর।
আরও পড়ুন:
দ্য স্প্যারোস নেস্ট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, দেশভাগ, ইংরেজদের বিদায়। হুরমতিকে ঘুরতে হয় এক শহর থেকে আরেক শহরে। ভাতের আশায়, আশ্রয়ের আশায়। অবশেষে ঘর বাঁধে লেকুকে নিয়ে।
ঔপন্যাসিক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হানুফা আলোচ্য চরিত্র দুটি থেকে কিছুটা আলাদা। অবলা, বুদ্ধিহীনা, জেদহীন, সরলা এক মাটির পুতুল। নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই। এ শতাব্দীর সমতট অঞ্চলের অক্ষরহীন নারীরা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, সীমাবদ্ধ গণ্ডির জীবন, ‘দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার’ নীতি প্রভৃতির মাঝে বসবাস সহনীয় হয়ে পড়েছে। নারী শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়ন, জাগরণ কোনো কিছুর স্পর্শ পায়নি তারা। বহু বছরের ঘুণে ধরা সামন্ত সমাজব্যবস্থার প্রভাব লঘু আকারে হলেও আজও হানুফাদের কাছে বিদ্যমান। হানুফারা কেবল সয়েই যাচ্ছে, সাজানো সালিশি বৈঠকে ‘রা’ উচ্চারণেও সাহস নেই, শক্তি নেই। তারা কেবল শোষিত মানুষের রক্ত বহন করছে।
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর নিজেও বেড়ে উঠেছেন প্রাচীন সমতট অঞ্চল বর্তমান কুমিল্লা জেলার পার্শ্ববর্তী কোনো এক গ্রামে। পেশাগত কারণে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ালেও শৈশব স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চলের মানুষদের জীবন-জীবিকা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, পরিবীক্ষণ করেছেন। এর প্রমাণ লক্ষ করা যায় চরিত্রগুলোর সংলাপ রচনায় স্থানীয় ভাষা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। এতে চরিত্রগুলো পূর্ণতা পায়, বিশ্বাস অর্জন করে পাঠককুলের।
বিলডাকিনির শব্দপ্রয়োগ, বাক্যগঠন, উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার, ঘটনাক্রম বর্ণনার রীতি ঋজু নয়, অনেকটা সরলরৈখিক। কাহিনি বিন্যাস, ঘটনার ক্রম বর্ণনায় মুনশিয়ানার পরিচয় না পেলেও যে কোনো ঘটনা বর্ণনায় বাহুল্য লক্ষণীয়। মওলানা আবু বকর, ইবরাহিম, বারীণ মাস্টারসহ জনতার সালিশি বৈঠক বর্ণনায় বাহুল্য প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। পাঠককুল ঘটনা, ঘটনাপরম্পরা ও পরিণতি আঁচ করতে পারলেও ডাকিনি বিলে হানুফার নৌকায় পার হওয়ার ঘটনা এবং অনাগত সন্তানের পরিচয় ও ভবিষ্যৎ বর্ণনায় ঔপন্যাসিক খানিকটা দীর্ঘ বক্তব্যের অবতারণা করেছেন।
একবিংশ শতাব্দীর এমন কালে এখনো টিকে থাকা সামন্ত সমাজ, ভূমি দখলদারদের হাতে হানুফারা কেবল ভোগ, লালসার বস্তু নয়, জীবনহরণের মাধ্যমও বটে। ঔপন্যাসিক গ্রামের নাম বিলডাকিনি হলেও একজন সরলা নারীকে ডাকিনি, অসতী বানিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে সাজানো বিচারব্যবস্থার প্রতীকী চিত্র এঁকেছেন সরল বর্ণনায়। যথার্থ সমাজচিত্র অঙ্কনে লেখকেরও সার্থকতা লক্ষণীয়।
এ ঘুণে ধরা সামন্ত সমাজব্যবস্থায় কখনো কখনো কাউকে কাউকে প্রতিবাদী মানুষ হতে লক্ষ করা যায়। এ তালিকায় বারীণ মাস্টার, বিউটি, নৌকার মাঝিকে পাঠক খুঁজে পান। যদিও তাদের কর্মব্যাপ্তি, প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্ষীণ, অপর্যাপ্ত। এটাও বলা চলে যে, উপন্যাসে বারীণ মাস্টার যখন অনাগত শিশুর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে রওনা হন, তাতে সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করলেও সমাজচিত্র বাস্তবে অনেকটা উল্টো। তবে বলা যেতে পারে, বারীণ মাস্টার নিজেই সমাজের ওই শোষিত শ্রেণির বিবেকবান প্রতিনিধিমাত্র, যিনি ঔপন্যাসিকের প্রতিনিধিও, যিনি প্রগতিশীল, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে লিপ্ত।
বিলডাকিনি, সংশপ্তক, টেস অব দা ডা’ভাভিলস- এ তিন উপন্যাসে নারীর দেশ, কাল, সমাজের ভিন্নতা থাকলেও মূলত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা শ্রেণি শোষণ, ভূমি মালিক-দাস ব্যবস্থা, সামন্ত শ্রেণির অস্তিত্ব, নারীদের দুর্বল অবস্থান প্রভৃতি নারীদের জাগরণ, নারী শিক্ষা এবং সাম্যবাদী সমাজ সৃষ্টিতে আজও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। সেদিক থেকে রাষ্ট্র, সমাজ বাস্তবতা চিত্রণে ঔপন্যাসিক নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর সার্থক বলা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি বাক্য উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘বাপের পরিচয় না থাকলে সমাজ কি কেবল মানুষ পরিচয়ে বাঁচতে দেবে ওকে।’ এ একটি বাক্য সমাজ বাস্তবতা চিত্রণে যথেষ্ট।
তিন উপন্যাসের তিন নারী-চরিত্রই পেটে আসা মানব সন্তানের বৈধতা প্রশ্নে কথিত সমাজ আর সমাজপতিদের কাছে পতিতা, নষ্টা আর জেনাকারী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। সমাজ তাদের বিচার করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। আর পূত-পবিত্র জেনাকারী পুরুষদের কেউ লোকসমাজের সামনে আনল না, বিচারের বিষয় তো প্রশ্নাতীত। এ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ সমাজ মানুষ আর কত শতাব্দী প্রত্যক্ষ করবে? বিউটির মতো করে আরও সহস্র আওয়াজ তুলে কে বলবে, ‘ধুলাবাই, ধমক দিবেন না। আমি দরবারে কথা বলছি।’
আরও পড়ুন:
অন্তিমের ইচ্ছাপত্র
সংশপ্তক উপন্যাসের হুরমতির বেঁচে থাকার সংগ্রামমুখর জীবন, টেসের পারিবারিক জীবিকার জন্য সংগ্রাম, অ্যালেক ও অ্যাঞ্জেলের প্রতারণা, অবশেষে কথিত সমাজ ও রাষ্ট্রীয় আইনে গলায় ফাঁস জড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডকে অবগাহন এবং বিলডাকিনি উপন্যাসের হানুফার নিষ্পেষিত জীবন, অবশেষে বারীণ মাস্টারের সঙ্গে অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্য যাত্রা- তিনটি উপন্যাসেই মূল এ ঘটনাপ্রবাহগুলো সমাজচিত্রণে স্থান, কালকে ভেদ করে সমাজব্যবস্থার এক চিরায়ত রূপ ঔপন্যাসিকরা অঙ্কন করেছেন- যা সর্বকালের, সর্বসমাজের প্রতিচিত্র। া