অপরাধ ঢাকতে শিমুল হয়ে যায় আমানুল্লাহ
ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার খুনে নেতৃত্ব দেওয়া ভাড়াটে খুনি সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে সাঈদের প্রকৃত নাম শিমুল ভূঁইয়া। পুরনো অপরাধ ঢাকতে ভোল পাল্টেছিলেন খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত এই সন্ত্রাসী; নতুন নামে করেছিলেন এনআইডি ও পাসপোর্ট। তার বিরুদ্ধে খুনসহ অন্তত দুই ডজন মামলা রয়েছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বোনের বাসা থেকে ধরা পড়ার পর সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে সাঈদ নামে পরিচয় দেন শিমুল। কিন্তু পুলিশি তদন্তে তার প্রকৃত পরিচয় বেরিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদে এমপি আনোয়ারুল খুনের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তিনি।
শিমুল ভূঁইয়া কীভাবে আমানুল্লাহ হলেন; কীভাবে ভুয়া পাসপোর্ট ও এনআইডি তৈরি করলেন- এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। কুখ্যাত এই খুনির ভোল পাল্টানোর ক্ষেত্রে যোগসাজশের অভিযোগে এসবি, পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও এনআইডি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা ফেঁসে যেতে পারেন বলে জানা গেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পড়াশোনা করা শিমুল ভূঁইয়া চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) প্রধান দাদা তপন মালিথার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, শিমুল ভূঁইয়ার গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নে। তার বাবার নাম কায়সার সাঈদ। মায়ের নাম দোলানা বেগম। স্ত্রী ফারজানা আক্তার। যশোরের অভয়নগরে গণেশ নামের একজনকে হত্যার অভিযোগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন শিমুল। ২০০০ সালে গ্রেপ্তার হন ইমান নামে আরেকজনকে হত্যার অভিযোগে। ওই মামলায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন। জামিনে বেরিয়ে ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ শুরু করেন শিমুল। তার বিরুদ্ধে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মামলা রয়েছে।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ নামে পাসপোর্ট বানান শিমুল। পাসপোর্ট করতে একই নামে তিনি এনআইডি তৈরি করান। নতুন এই নামেই কলকাতায় গিয়েছিলেন শিমুল। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, কলকাতার নিউটাউনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার পর ১৫ মে দেশে ফেরেন শিমুল। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই তিনি আনোয়ারুলকে হত্যার দায় স্বীকার করে বলেন, হত্যার মিশন বাস্তবায়নে নিহতের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান ওরফে শাহিনের সঙ্গে শিমুলের ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়। আনোয়ারুলের সঙ্গে শাহিনের স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডির ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই নারীর টোপ ফেলে ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শিমুল।
শিমুলের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বর্তমানে খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য। শিমুলের ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া (শিপলু) দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। এমপি আনোয়ারুল হত্যাকা-ের বিভিন্ন পর্যায়ে চরমপন্থি সংগঠনের অনেক নেতা সম্পৃক্ত ছিলেন। শিমুল ভূঁইয়া যার ডাকে ভাড়ায় খেটেছিলেন, সেই আখতারুজ্জামান শাহিনও পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষনেতা ডা. মিজানুর রহমান ওরফে টুটুলের আত্মীয়। মিজানুর রহমান ২০০৮ সালে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
গত সোমবার খুলনা জেলা পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সদস্য পদে শিমুলের স্ত্রী সাবিনাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তাকে বিজয়ী করতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। সে সময় শিমুল প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও গ্রেপ্তার করা হয়নি বরং পুলিশের খাতায় তাকে ‘পলাতক’ দেখানো হয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ মে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খুন হন ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিন মিঠু। মিঠুর ছোট ভাই রাজ সরদার হত্যা মামলা করেন। ২০১৮ সালে শিমুলকে প্রধান ও মুক্তাকে চার নম্বর আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। বাদী নারাজি দিলে আদালত তদন্তভার দেন পিবিআইয়ের হাতে। গত ১০ মে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পিবিআই। এতে শিমুল প্রধান আসামি থাকলেও মুক্তার অবস্থান ৭। পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়। বাদীপক্ষ এবারও নারাজি দিলে আদালত শুনানির জন্য আগামী ২৭ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
মিঠুর বড় ভাই সেলিম সরদার বলেন, আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ ধরছে না। ভাই হত্যার বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।