ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেই খুনের স্পট হয় কলকাতা

এমপি আনোয়ারুল আজিম হত্যাকাণ্ড

শাহজাহান আকন্দ শুভ
২৪ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেই খুনের স্পট হয় কলকাতা

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের নীলনকশা হয়েছিল অন্তত তিন মাস আগে। এরপর এ মিশন কোথায়, কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে- এ নিয়ে সিরিজ বৈঠক করে খুনিচক্র। বেশিরভাগ বৈঠক হয় মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিনের গুলশানের বাসায়। ধানমন্ডির একটি বাসায়ও বৈঠক হয়। দেশের ভেতরে হত্যা করা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহজেই এর রহস্য উদ্ঘাটন করে ফেলতে পারে; ধরা পড়ে যেতে পারে খুনিচক্র- এমন শঙ্কা থেকে খুনের মিশন বাস্তবায়নের স্পট হিসেবে বেছে নেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকে। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এ হত্যারহস্যের চাদর অনাবৃত হয়ে পড়ে একটি ফোনকলে। খুনের কা- উদ্ঘাটনে

অনুঘটক হিসেবে কাজ করে সেই ফোনকল। এরপর একে একে খুনিচক্রের বেশ কয়েকজন ধরা পড়ে। ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার চরমপন্থি নেতা সৈয়দ আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া এ খুনের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, খুনিচক্রের এক সহযোগী ভারতীয় একটি ফোন নম্বর থেকে বাংলাদেশে দুটি কল করেন। এই কলের সূত্র ধরেই ওই চক্রের নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে ঢাকা ও কলকাতার পুলিশ। এরপর একে একে কয়েকজন খুনিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের ঘটনায় ঢাকায় আগেই তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর গতকাল বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি পুলিশ আরেক কিলার সিয়ামকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে। সে বাংলাদেশি নাগরিক। এ ছাড়া জুবের নামের এক গাড়িচালককেও আটকের তথ্য পাওয়া গেছে।

দুজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করছেন স্থানীয় পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারা।

এদিকে ঢাকায় গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়াসহ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি পুলিশের তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল বাংলাদেশে এসেছে এবং গ্রেপ্তার প্রত্যেকের সঙ্গেই কথা বলেছে। এ ছাড়া প্রতিনিধি দলের সদস্যরা গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘসময় বৈঠক করেন, তদন্তের সর্বশেষ ফলাফল নিয়ে কথা বলেন এবং পরস্পর তথ্য আদান-প্রদান করেন।

এমপি আনার খুনের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলেননি ভারত ও বাংলাদেশের তদন্তকারীরা। তবে তারা খুনের কারণ হিসেবে স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়টিই সামনে রাখছেন। গতকাল সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, বন্ধু শাহিনের কাছে মোটা অংকের টাকা পাওনা ছিলেন এমপি আনার। এ টাকা মেরে দিতেই বন্ধুকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন শাহিন।

কলকাতায় সিয়াম গ্রেপ্তার হলেও জাহিদ ওরফে জিহাদ এখনো পলাতক। তাকেও খোঁজা হচ্ছে। গ্রেপ্তার সিয়ামের বাড়ি ভোলা জেলায়। গত ১৩ মে এমপি আনার খুনে এই সিয়ামও সরাসরি জড়িত। ঘটনার পর ১৫ মে শিমুল ভূঁইয়া দেশে ফিরে এলেও সিয়াম ও জিহাদ ওরফে জাহিদ কলকাতায় থেকে যান।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ মে সিয়াম কলকাতায় যান। খুনের আগে-পরে পুলিশ তার নেপাল ভ্রমণের প্রমাণ পেয়েছে। নেপাল থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পরই সে গ্রেপ্তার হয় বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিরা অনেক দিন ধরে হত্যার সুযোগ খুঁজছিল।

তিনি বলেন, ঢাকার গুলশান ও ধানমন্ডির দুটি বাসায় দুই থেকে তিন মাস ধরে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার পরিকল্পনা হয়। ঢাকায় ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকায় হত্যার স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় কলকাতা।

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আনোয়ারুলকে হত্যার পর লাশ গুম করতে শরীর টুকরো টুকরো করে হাড্ডি ও মাংস আলাদা করা হয়। এরপর কেউ যাতে সন্দেহ করতে না পারে, এ জন্য হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ওই বাসা থেকে বের করা হয়। কিন্তু কোথায় মরদেহের খ-িত অংশ ফেলা হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।’ আনোয়ারুল আজিমের পুরো লাশ না পাওয়া গেলেও খ-িত মরদেহ পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, শিমুল ভূঁইয়া চরমপন্থি দলের নেতা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো হত্যা ও অস্ত্র মামলা আছে।

পুলিশের তদন্তকারীরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আক্তারুজ্জামান শাহিন কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জিবা গার্ডেনসে ফ্ল্যাট ভাড়া করতে ৩০ এপ্রিল বান্ধবী সেলেস্তা রহমানকে তার সঙ্গে কলকাতায় নিয়ে যান। সঙ্গে আমানুল্লাহকেও। কিলার গ্রুপকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে শাহিন দেশে ফিরে আসেন। এমপি আনার যে ১২ মে কলকাতায় যাবেন, তা আগে থেকেই জানতেন শাহিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী খুনিরা এমপি আনারকে হত্যার জন্য একাধিক চাপাতিও সংগ্রহ করে রাখে। ১৩ মে একটি লাল রঙের গাড়িতে কৌশলে এমপি আনারকে নিউটাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। দুপুরে এমপি আনার সঞ্জিবা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করার পর শিমুল ভূঁইয়া তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদকে নিয়ে আনারকে চাপাতির মুখে জিম্মি করে। এরপর শুরু হয় ধস্তাধস্তি। একপর্যায়ে আনারকে জাপটে ধরে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর শিমুল বিষয়টি জানান শাহিনকে। শাহিনের নির্দেশে লাশ গুম করতে এমপি আনারকে কেটে টুকরো টুকরো করে হাড়-মাংস পৃথক করা হয় এবং তাতে যেন দুর্গন্ধ না ছড়ায় সে জন্য হলুদের গুঁড়া ছিটানো হয়। এরপর ফ্ল্যাটের কাছেই শপিংমল থেকে আনা হয় বড় ট্রলিব্যাগ ও পলিথিন। এমপি আনারের মরদেহের টুকরোগুলো পলিথিনে পেঁচিয়ে ট্রলিব্যাগে ভরা হয়। ঘটনার রাতে লাশের টুকরোসহ দুটি ট্রলিব্যাগে বাসাতেই রাখা হয়। এর মধ্যে তারা বাইরে থেকে ব্লিচিং পাউডার এনে ঘরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে। হত্যাকা-ের পর দিন বিকালে একটি ট্রলিব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পাশের একটি শপিংমলের সামনে ট্রলিব্যাগটি সিয়ামের হাতে তুলে দেন শিমুল। সিয়াম সেই ব্যাগ নিয়ে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা গাড়িতে চড়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর ব্যাগটি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সিয়াম। লাশের টুকরোসহ আরেকটি ব্যাগ বাসাতেই ছিল। সেই ব্যাগ থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই লাশের টুকরোসহ ব্যাগটি সহযোগীদের অন্য কোথাও ফেলে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ১৫ মে ঢাকায় চলে আসেন শিমুল। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আমানের দুই সহযোগী এমপি আনারের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে দুদিকে চলে যায় যেন তদন্তকারীরা আনারের অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্ত হন। এ কৌশলের পরও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তকারীদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়।

খুনের ঘটনাস্থল কেন কলকাতা

চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়াই এমপি আনারকে কলকাতায় খুন করতে মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিনকে পরামর্শ দেন। শাহিনকে একাধিক খুনে হাতপাকানো শিমুল পরামর্শ দেন, বাংলাদেশে খুন করা হলে সহজে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। এর পরই আনারকে কলকাতায় খুন করার ছক তৈরি করেন শিমুল ও শাহিন।

শাহিনের গুলশানের বাসায় তালা

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আক্তারুজ্জামান শাহিনকে খুঁজতে গিয়ে তার গুলশানের বাসায় একটি মিনি বারের সন্ধান পেয়েছে। ওই বাসা থেকে শাহিনের একটি ডায়েরি জব্দ করেছে। যেখানে এই খুনে কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে তা লেখা রয়েছে। পুলিশ ইতোমধ্যে শাহিনের বাসায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ

আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় আগামী ৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলে গতকাল নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গত ২২ মে সন্ধ্যায় আনোয়ারুল আজিমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা করেন।