হেলিকপ্টার বহরের কর্মকর্তা জানালেন সেদিন কী ঘটেছিল
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দোল্লাহিয়ানসহ তাদের সফরসঙ্গীদের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ ইরানবাসী। কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, ইতোমধ্যে তার তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই রাইসির হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ গোলাম হোসেইন ইসমাইলি। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ইরনাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দুর্ঘটনার ব্যাপারে বিস্তারিত বলেন।
গত ১৯ মে রবিবার আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে যান প্রেসিডেন্ট রাইসি। অনুষ্ঠান শেষে তিনটি হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের
রাজধানী তাবরিজে ফিরছিলেন রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্য কর্মকর্তারা। পথে জোলফা এলাকার কাছে দুর্গম পাহাড়ে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। তবে বহরের অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়। দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান চালানোর পর প্রেসিডেন্ট রাইসিসহ হেলিকপ্টারটির মোট নয় আরোহীকেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বলা হচ্ছে, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
ঘটনার দিন ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটির পাশে আরেকটি হেলিকপ্টারে ছিলেন প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ গোলাম হোসেইন ইসমাইলি। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট রাইসির হেলিকপ্টারটি যেখানে বিধ্বস্ত হয়েছিল, ইরানের সেই ভারজাকান অঞ্চলের আবহাওয়া ওড়ার শুরুতে এবং বেশিরভাগ সময়জুড়ে স্বাভাবিকই ছিল। ঘটনার দিন দুপুর ১টার দিকে হেলিকপ্টারগুলো যাত্রা শুরু করে। প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ছিল বহরের বাকি দুটি হেলিকপ্টারের মাঝখানে। এগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের পাইলট ক্যাপ্টেন মোস্তাফাভি।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইসমাইলি বলেন, যাত্রার ৪৫ মিনিট পর মোস্তাফাভি বাকিদের নির্দেশ দেন কাছের একটি মেঘের সংস্পর্শ এড়াতে হেলিকপ্টারগুলোকে আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে। মেঘের ওপর ৩০ সেকেন্ড ওড়ার পর আমাদের পাইলট খেয়াল করেন, মাঝখানের হেলিকপ্টারটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। এরপর আমাদের পাইলট ওই হেলিকপ্টারটি খুঁজতে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকেন। এরপর তারা বেশ কয়েকবার রেডিওর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও চালান বলে জানান প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ। এদিকে মেঘের কারণে তাদের হেলিকপ্টারটি নিচে নামানোও যাচ্ছিল না। একটু পর কাছাকাছি একটি তামার খনিতে তারা অবতরণ করে। সেখানেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সুরক্ষা ইউনিটের সদস্যদের বারবার কল করা হচ্ছিল, তবে কেউ সাড়া দেননি।
অন্য আরেকটি হেলিকপ্টারের পাইলটরা ক্যাপ্টেন মোস্তাফাভির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তবে ফোন ধরেন তাবরিজে জুমার নামাজের ইমাম ও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনির মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আল-হাশেম। তার অবস্থা তখন ভালো ছিল না। আল-হাশেম জানান, তাদের হেলিকপ্টারটি একটি উপত্যকায় বিধ্বস্ত হয়েছে। এরপর ইসমাইলি নিজেও আল-হাশেমের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় যোগাযোগ করেছিলেন এবং একই উত্তর পেয়েছিলেন। ইসমাইলি বলেন, যখন আমরা দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাই, তখন সবাইকে মৃত দেখি। রাইসি এবং তার সঙ্গীরা তাৎক্ষণিকভাবেই নিহত হয়েছিলেন বলেই মনে হয়েছে। শুধু আল-হাশেম হয়তো ঘণ্টাখানেক বেঁচে ছিলেন।
এদিকে গতকাল বুধবার সকালে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও তার সফরসঙ্গীদের জানাজা পড়িয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। জানাজার একটি ভিডিও খামেনির এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশও করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর তেহরান বিশ^বিদ্যালয়ে বৃদ্ধ খামেনি লাঠিতে ভর দিয়ে মরদেহগুলোর কাছে এগিয়ে আসছেন। এরপর তিনি সমবেত সবাইকে নিয়ে জানাজা পড়েন। রাইসির জানাজায় কালো কাপড় পরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কয়েক লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাইসির জন্মশহর ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে দাফন করা হবে।
সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে এতদিন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির একজন সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এখন তার মৃত্যুর পর সর্বোচ্চ নেতার পদে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসছে খামেনির ছেলে মোজতবা খামেনির নাম। ৫৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি প্রকাশ্যে তেমন না এলেও পর্দার পেছন থেকেই দীর্ঘদিন দেশের নীতিনির্ধারণীতে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। তাকে নিয়োগ দেয় বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি। পররাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ৮৫ বছর বয়সী খামেনির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আয়াতুল্লাহ খামেনির মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সাল থেকে সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্বে রয়েছেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এখন এই সর্বোচ্চ নেতার অবসর এবং তার জায়গায় নতুন উত্তরসূরি আসার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বার্লিনভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর মিডলইস্ট অ্যান্ড গ্লোবাল অর্ডারের পরিচালক আলি ফাথোল্লাহ-নেজাদ বলেছেন, রাইসিকে খামেনির উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হতো কিনা তা বলা কঠিন। কিন্তু খামেনি দীর্ঘদিন ধরে তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে আসছিলেন। তবে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে ছেলে মোজতবাকে দায়িত্ব দেওয়ার ইচ্ছা আছে খামেনির। যদিও ইরানের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে পারিবারিক শাসন নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনকে উৎখাত করার সময় পারিবারিক শাসনের বিরোধিতা করা হয়েছিল। কিন্তু রাইসির মৃত্যুতে খামেনির উত্তরসূরি হিসেবে মোজতবাকে ভাবা হচ্ছে।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় মোজতবার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এ থেকেই তার শক্তিশালী ভূমিকার ইঙ্গিত মেলে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ওপরও মোজতবার বড় প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া ইরানের গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে গভীর যোগাযোগ এবং ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে মোজতবার উচ্চস্তরের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়।
তবে ইরানের অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজের ছেলেকে উত্তরসূরি করবেন না। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইসলামি প্রজাতন্ত্রের একটি মৌলিক নীতি ছিল, এটি উত্তরাধিকার বা বংশগত শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। আয়াতুল্লাহ খামেনি ছেলেকে উত্তরসূরি করলে মনে হতে পারে বংশানুক্রমিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, সামনের দিনগুলোতে আরও কট্টোরপন্থিরাই ইরানকে পরিচালনা করবেন। এর আওতায় দেশটির পররাষ্ট্রনীতি, আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য যন্ত্রাংশ তৈরির লক্ষ্য থেকে তারা একচুলও বিচ্যুত হবে না।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
এদিকে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুকে বিরাট ক্ষতি বলে অভিহিত করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকের সময় মস্কোর কাছে রাইসিকে খুব নির্ভরযোগ্য অংশীদার এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী একজন মানুষ বলে বর্ণনা করেন পুতিন।