এমপি আনোয়ারুল ভারতে খুন
পরিকল্পনা বাংলাদেশে, হত্যা কলকাতার ফ্ল্যাটে
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অভিজাত একটি ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, আনারকে খুনের পরিকল্পনা করা হয় বাংলাদেশ থেকে এবং বাস্তবায়ন করা হয় কলকাতায়। কিলিং মিশনে অংশ নেয় দুই ভারতীয়সহ পাঁচজন। গত ১৩ মে হত্যাকা-ের পর লাশ টুকরা টুকরা করে ৪টি ট্রলিব্যাগে ভরে ফ্ল্যাট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। লাশের টুকরাগুলো একাধিকবার হাতবদল হওয়ায় তা খুঁজে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিন গত ২০ মে ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু যান। সেখান থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তবে ভাড়াটে খুনি সৈয়দ আমানুল্লাহ এবং শাহিনের বান্ধবী সেলেস্তা রহমানসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় নিহতের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় একটি মামলা করেছেন, যেখানে খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ খুনের রহস্য উদঘাটনের পাশাপাশি জড়িতদের গ্রেপ্তারে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইতোমধ্যেই আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে।
আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হওয়ার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনকে ফোন করে ধৈর্যধারণ করতে বলেছেন এবং বিচারের আশ^াস দিয়েছেন।
ঢাকায় গ্রেপ্তার কিলার গ্রুপের সদস্যদের জবানবন্দির সূত্র ধরে ডিবি পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, আনোয়ারুল আজিমের সঙ্গে স্বর্ণ চোরচালান, হুন্ডি ও অস্ত্রের ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় বাল্যবন্ধু ঠিকাদার আক্তারুজ্জামান শাহিনের। শাহিন তার পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে ভাড়াটে খুনি এবং পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির একসময়ের ক্যাডার সৈয়দ আমানুল্লাহর সঙ্গে চুক্তি করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ৩০ এপ্রিল আমানুল্লাহ, শাহিন ও শাহিনের বান্ধবী সেলেস্তা রহমান কলকাতায় যায়। এরপর আরও দুই কিলার কলকাতায় যায় বাংলাদেশ থেকে। তাদেরও ভাড়া করে শাহিন। শাহিন পরিকল্পনার সব ঠিকঠাক করে ১০ মে দেশে ফিরে আসেন। কিলাররা থেকে যায় কলকাতায়। ১২ মে আনোয়ারুল আজিম কলকাতা গেলে পরদিন ১৩ মে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে তাকে একটি লাল রঙের গাড়িতে কলকাতার নিউটাউনের অভিজাত ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ফ্ল্যাটেই ৫ কিলার তাকে খুন করে। সেদিন বিকাল ৫টা ১১ মিনিটে কিলিং মিশন শেষে প্রথমে একজন কিলার একটি ট্রলিব্যাগসহ বেরিয়ে আসে। এরপর বাকিরাও পর্যায়ক্রমে বেরিয়ে আসে। আনারের লাশের টুকরা মোট ৪টি ট্রলিব্যাগে করে বের করে নিয়ে যায় কিলাররা। হত্যাকা-ের সঙ্গে ভারতীয় নাগরিক জিহাদ ওরফে জাহিদ ও সিয়ামও জড়িত ছিল। কলকাতা পুলিশ তাদের আটক করেছে।
নিউটাউনের ফ্ল্যাটের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ১৩ মে নিউটাউনের সঞ্জিবা গার্ডেনসের বিইউ-৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটে ঢোকেন আনোয়ারুল আজিম। এরপর তাকে আর ওই ফ্ল্যাট থেকে বের হতে দেখা যায়নি। ফলে ধরে নেওয়া হয়েছে, তাকে হত্যার পর লাশ টুকরা টুকরা করে ট্রলিব্যাগে বের করা হয়েছে। আর সঞ্জিবা গার্ডেনসের ওই ফ্ল্যাটের ভেতরেই রক্তের দাগসহ হত্যাকা-ের অন্যান্য ক্লু রয়েছে।
হত্যাকা-ে জড়িতরা পুলিশকে বলেছে, কিলিং মিশন শেষে তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়। একটি গ্রুপ ঘটনার দিন বিকালেই লাশের টুকরার দুটি ব্যাগ নিয়ে নিউটাউনের একটি পাবলিক টয়লেটের সামনে যায়। সেখানে ব্যাগ হস্তান্তর করে। আরেকটি গ্রুপ পরদিন বাসা থেকে আরও দুটি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায়। আর গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করতেই জড়িতরা আনারের দুটি সিম নিয়ে দুই এলাকায় অবস্থান করে।
চাঞ্চল্যকর এ খুনের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, হত্যাকা-ে পারিবারিক, আর্থিক নাকি অন্য কোনো বিষয় জড়িত, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছি। আমরা কয়েকজনকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলছি এবং হত্যার মোটিভ জানার চেষ্টা করছি। বাকিদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
এমপি আনারের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে চিকিৎসক। ডরিন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যয়নরত। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বাবার সঙ্গে ভিডিও কলে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। বাবা আমাকে বলেছিলেন, তিনি দুদিনের মধ্যেই ভারত থেকে ফিরবেন। তিনি ঢাকায় ফিরে আমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অশ্রুসিক্ত ডরিন বলেন, ‘আমি এতিম হয়ে গেলাম। যারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’
সাংবাদিকরা তার কাছে জানতে চান, পুলিশ যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে, তাদের তিনি চেনেন কি না।
উত্তরে ডরিন বলেন, আমি তাদের কাউকেই চিনি না। কিন্তু তাদের চিনতে চাই, জানতে চাই- কেন তারা আমার বাবাকে হত্যা করল।
কাউকে সন্দেহ করছেন কি না- এমন প্রশ্নে ডরিন বলেন, কাউকে আমি সন্দেহ করছি না। কিন্তু খুনিদের পরিচয় জানতে চাই। তারপর আমি আমার সন্দেহের কথা প্রকাশ করব।
আনোয়ারুল আজিম আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায় গতকাল বিকালে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেছেন ডরিন। মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচএম আজিমুল হক। তিনি বলেন, নিহত সংসদ সদস্যের মেয়ে এ মামলা দায়ের করেছেন। তদন্ত করে মামলার আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
গ্রেপ্তার আমানুল্লাহ সম্পর্কে জানা গেছে, তিনি পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির একজন কিলার। খুনের মাস্টারমাইন্ড শাহিনের দূরসম্পর্কের বেয়াই আমানুল্লাহ। তিনি দুটি হত্যা মামলার আসামি। একটিতে সাত বছর জেল খেটে ২০১০ সালে বের হন। অন্য মামলায় তার ১৩ বছরের সাজা হয়। আনারকে খুন করার জন্য আমানুল্লাহর সঙ্গে চুক্তি করেন শাহিন। চুক্তি অনুযায়ী আমানুল্লাহ, শাহিন ও শাহিনের বান্ধবী ৩০ এপ্রিল কলকাতায় যান।
হত্যাকা-ের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর শাহিন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন জানিয়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শাহিন গত ১০ মে কলকাতা থেকে দেশে ফেরেন। এরপর তার একটি গাড়ি ২৭ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। হত্যাকা-ের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর ২০ মে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ভিসতা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে দিল্লি যান শাহিন। দিল্লি থেকে কাঠমান্ডু যান গত মঙ্গলবার বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে। সেখান থেকে তিনি দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। শাহিনের একটি ডায়েরি ও একটি গাড়ি জব্দ করেছে পুলিশ। ডায়েরিতে লেখা রয়েছে আনার হত্যাকা-ে কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে। শাহিনের বসুন্ধরা এলাকার বাসা থেকে ডায়েরিটি জব্দ করেছে পুলিশ।
হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড শাহিন ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই। গতকাল রাতে মোবাইল ফোনে সহিদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তার ভাই আমেরিকার নাগরিক। তিনি আমেরিকায় ফিরে গেছেন নাকি অন্য কোনো দেশে গেছেন সেটা জানেন না। তবে দেশের বাইরে আছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, আনোয়ারুল আজীম আনারকে কলকাতার একটি বাসায় ‘পরিকল্পিতভাবে খুন’ করা হয়েছে। তিনজনকে বাংলাদেশ পুলিশ আটক করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্ত চলছে, যারা যারা এ খুনের সঙ্গে জড়িত সবার বিষয়ে জানতে পারব। ভারতের পুলিশও সহযোগিতা করছে।
কলকাতা সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদি ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেছেন, যে ফ্ল্যাটে হত্যাকা- হয়েছে সেই ফ্ল্যাটের মালিকের নাম সঞ্জীব রায়। তিনি পশ্চিমবঙ্গের এক্সাইজ (শুল্ক) দপ্তরের কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আখতারুজ্জামান শাহিন নামে এক মার্কিন নাগরিককে সঞ্জীব রায় ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ভিকটিম বা অভিযুক্তদের কী সম্পর্ক, কলকাতা পুলিশ সেটি তদন্ত করছে। সেই সঙ্গে লাশ উদ্ধার ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ।
১৩ মে কলকাতার পুরনো বন্ধু গোপালের বাসা থেকে বের হওয়ার পর রাস্তায় সাদা রঙের একটি গাড়ি থেকে নেমে আনারকে রিসিভ করেন এক ব্যক্তি। এরপর আনার ওই গাড়িতে চড়েন। এতে চালক, আনারসহ তিনজন ছিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর লাল রঙের আরেকটি গাড়িতে ওঠেন আনার। ওই গাড়িতে আখতারুজ্জামান শাহিনের বেয়াই সৈয়দ আমানুল্লাহ ছিলেন। আখতারুজ্জামান ও আমানুল্লাহর বাড়িও আনারের এলাকায়।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন
সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গোয়েন্দারা দেখেন, ১৩ মে পৌনে ১টার দিকে সংসদ সদস্যকে বহনকারী লাল রঙের গাড়ি কলকাতার অভিজাত এলাকা নিউটাউনের আবাসিক ভবন সঞ্জিবা গার্ডেনসে প্রবেশ করে। ৫টা ১১ মিনিটের দিকে এমপির জুতা ও পলিথিনের দুটি বড় ব্যাগ হাতে নিয়ে ওই বাসা থেকে আমানুল্লাহ ও কিলিং মিশনের আরেকজন বেরিয়ে আসে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান- হত্যার পর লাশের টুকর ৪টি ব্যাগে ভরা হয়। আরও দুটি ব্যাগ নিয়ে ১৪ মে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে আসে কিলিং মিশনে জড়িত আরেকটি গ্রুপ।
জানা গেছে, মাস্টারমাইন্ড শাহিন ঠিকাদার। বাংলাদেশে বর্তমানে তার কয়েকশ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ চলমান। ঝিনাইদহে শৈশব-কৈশোরের একটি বড় সময় বাল্যবন্ধু আজিমের সঙ্গে কেটেছে তার।
হত্যার ছকের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে ভাড়াটে দুই খুনিকে কলকাতায় নেওয়া হয়। তাদের দুজনের পাসপোর্ট তৈরি করে দেন শাহিন। হত্যা মিশনের ৭-৮ দিন আগে বাংলাদেশি দুই ভাড়াটে কিলার কলকাতায় যায়। আর সেখানে আরও দুই ভারতীয় কিলারকে ভাড়া করা রাখা হয়েছিল আগে থেকেই।