অবৈধ পদোন্নতি ঢাকতে চাকরিবিধি বদলের চেষ্টা

আজাদুল আদনান
১৯ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অবৈধ পদোন্নতি ঢাকতে চাকরিবিধি বদলের চেষ্টা

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অ্যাডহক (অস্থায়ী) ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ৪৩০ চিকিৎসককে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা থেকে ক্যাডার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল বিধি ভঙ্গ করে। পদোন্নতির জন্য চাকরি স্থায়ীকরণ, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষা ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা পাসের বিধান থাকলেও তাদের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। এ নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট চলছে। এবার আরেক দফা এগিয়ে বিধিবহির্ভূত এসব পদোন্নতিকে বৈধতা দিতে চাকরি বিধিমালাতেই সংশোধন চাইছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ জন্য এরই মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে চাকরি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির জন্য শর্ত হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং বিভাগী পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রিটের বিষয়টি গোপন করে এই উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সময়ে এই উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রচেষ্টাটি সফল না হওয়ায় বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিষয়টিতে জোর দেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ প্রক্রিয়ায় সদ্য ক্যাডারর্ভুক্তদের স্থায়ীকরণের শর্ত বা সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি প্রদান সম্পূর্ণ অবৈধ বলে জানিয়েছেন বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডাররা। সরকারি চাকরিবিধিমালাও তাই বলছে। নিয়ম অনুযায়ী, বিসিএস ক্যাডারে যোগদানকৃত একজন নবীন চাকরিজীবীকে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষা, কমপক্ষে চার বছরের সন্তোষজনক চাকরিকাল এবং সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা- এই চারটি ধাপ কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে পেরিয়ে উচ্চ দায়িত্ব পালনে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং বিভিন্ন উচ্চপদে পদায়িত হন। এই নিয়মের বাইরে এখনো কোনো ক্যাডারের পদোন্নতির নজির নেই স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য খাতে। তা সত্ত্বেও বিধিবহির্ভূত উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিধি ভঙ্গ করে স্বাস্থ্য ক্যাডার পদে পদোন্নতি শুরু হয় ২০১৯ সালে। ওই বছর ১১৫ জনকে পদোন্নতি দিয়ে সহকারী অধ্যাপক করা হয়। পরে ২০২০ সালে ২৬৮ জনকে এবং ২০২১ সালে ৪৭ জনকে জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে অ্যাডহক থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বিষয়টি জানতে পেরে এর প্রতিকার চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় বরাবর অভিযোগ করে স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন। এ নিয়ে ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট হাইকোর্টে রিট করেন সংক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা, যা এখনো বিচারাধীন।

এই অবস্থায় অবৈধ এসব পদোন্নতিকে বৈধতা দিতে অ্যাডহক চিকিৎসকদের চাকরি স্থায়ীকরণ ও সিনিয়র স্কেল থেকে অব্যাহতি প্রদানে আইনের সংশোধনের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে গত বছরের ১৮ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আলমগীর কবীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে অ্যাডহক ভিত্তিতে স্বাস্থ্যে চিকিৎসক রয়েছেন ১ হাজার ৯৮৯ জন। এসব চিকিৎসককে ক্যাডারভুক্তির জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১-এর সংশোধনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এসেছে। এর প্রেক্ষিতে ২০২২ সালে (আবেদনকারীদের) ক্যাডারভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যা বিধি অনুযায়ী ৪২তম বিসিএসের পরপর ক্যাডার হিসেবে মর্যাদা পাবেন। তবে এসব চিকিৎসকের নন-ক্যাডারে চাকরি স্থায়ীকরণ হলেও পুনরায় ক্যাডারে চাকরি স্থায়ীকরণ করতে হবে।

এরা আগে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের বিষয়ে গত বছরের ২৪ জানুয়ারি মতামত দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানায়, অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগকৃত চিকিৎসকরা ১২ বছরের বেশি হওয়ার পর ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ৪৩০ জনকে পূর্বে জুনিয়র কনসালট্যান্ট এবং সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তাদের নতুন করে স্থায়ীকরণ এবং সিনিয়র স্কেল পাস করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমতাবস্থায় সিনিয়র স্কেল পরীক্ষার বিষয়টি প্রমার্জন করে ক্যাডারে অন্তর্ভুক্তির আদেশ অব্যাহত রাখা যেতে পারে।

এই বিষয়টি এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে রয়েছে বলে জানা গেছে। তা জানতে পেরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছেন বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডাররা। গত ৮ এপ্রিল দেওয়া ওই চিঠিতে আইনের সংশোধন প্রক্রিয়া ও উদ্যোগের বেশকিছু ত্রুটি ও বিধি ভাঙ্গার তথ্য তুলে ধরা হয়। স্বাস্থ্য ক্যাডাররা বলছেন, এখন পর্যন্ত নন-ক্যাডারদের সুবিধা দেওয়ার জন্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয় বিধি থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের বিধি সংশোধন করে চাকরিবিধিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ক্যাডারভুক্তির আগেই এসব অবৈধ পদোন্নতির কারণে নিয়মিত ক্যাডাররা আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বিসিএস ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তা কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের নিউরো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. খালেদ আহমেদুর রহমান বলেন, ‘বিধিমালা অনুযায়ী চাকরির বয়স ৫০ বছর হলেই কেবল ফাউন্ডেশন ট্রেনিং ও বিভাগীয় পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি পাবেন। সেখানে মাত্রই তারা ক্যাডারভুক্ত হলেন। তাহলে কেন তাদের এই অব্যাহতি দিতে হবে, যা ক্যাডারের চিকিৎসকরা কখনোই পায়নি?

জানতে চাইলে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আ ম সেলিম রেজা আমাদের সময়কে বলেন, ‘যার যেটা প্রাপ্য নয়, তাকে সেটা দিলে কখনোই ভালো কিছু হয় না। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে এটি করা হচ্ছে। যে সুবিধা ক্যাডাররা পায়নি কখনো, সেটি নন-ক্যাডাররা কীভাবে পেতে পারে।’

তবে নিজেদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে অ্যাডহক চিকিৎসকরা বলছেন, গত ১৪ বছর স্বাস্থ্য খাতে নানা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন তারা। এ বিষয়ে অ্যাডহক থেকে নিয়োগ পাওয়া সরকারের জাতীয় পুষ্টিসেবা বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. নন্দলাল সূত্রধর বলেন, এক সময় উপজেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা পাওয়া যেত না। সেই দুর্দিনে ১২০/১২২ জন কর্মকর্তা অ্যাডহক থেকে হাল ধরেন। এটা একটা সিস্টেম। এখানে কারও ক্ষতি করা বা পিছিয়ে পড়ার কিছু নেই।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) ড. মো. জিয়াউদ্দীন আমাদের সময়কে বলেন, আমার জানা মতে, এখন একটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আছে। তবে বিস্তারিত বলতে পারবেন যুগ্ম সচিব জাকিয়া পারভীন। জাকিয়া পারভীন এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর আমাদের সময়কে বলেন, ‘মানবিক কারণে তাদের ক্যাডারভুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে স্থায়ীকরণ সিনিয়র স্কেলের প্রমার্জনার বিষয়টি দেখা হচ্ছে। তবে ক্যাডারদের চেয়ে তারা জ্যেষ্ঠতা পাবেন না।’