দুধ-মাংসের দাম কমাতে সমাধান মিলবে ঘাসে

আবু আলী
১৮ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
দুধ-মাংসের দাম কমাতে সমাধান মিলবে ঘাসে

অতিরিক্ত দামের কারণে বেশির ভাগ পরিবারেই মাংস এখন বিলাসী পণ্যের তালিকায় উঠেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশির ভাগই শুধু আত্মীয়স্বজন এলে গরু বা খাসির মাংস কেনে। অথচ কয়েক বছর আগেও সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে তারা নিয়মিত মাংস খেতেন। এক দশক আগে যেখানে ৩০০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস কেনা যেত, বর্তমানে রাজধানীতে এক কেজি গরুর মাংসের জন্য খরচ করতে হয় ৮শ টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশেরও বেশি। আর খাসির মাংসের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ১১শ টাকায় উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবাদিপশুর উৎপাদন খরচ বাড়ায় প্রভাব পড়ছে মাংসের দামে। আগে গবাদিপশুর খাদ্যতালিকায় বড় অংশ ছিল সবুজ ঘাস। এখন চারণভূমি কমে যাওয়ায় এবং কম সময়ে গরু মোটাতাজা করতে খামারিরা সবুজ ঘাসের পরিবর্তে দানাদার পশুখাবারে ঝুঁকেছেন। আর দানাদার খাদ্যের দাম (গমের ছাল, সরিষার খৈল, ছোলার ভুসি ও খেসারি) এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। সবুজ ঘাসের ব্যবহার বাড়াতে পারলে গবাদিপশুর উৎপাদন খরচ কমবে। তাতে নেমে আসবে মাংসের দামও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গবাদিপশুর জন্য এক কেজি দানাদার খাদ্য কিনতে ব্যয় হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অন্যদিকে এক কেজি সবুজ ঘাস কিনতে কৃষককে খরচ করতে হয় মাত্র ৪ থেকে ৫ টাকা। পুষ্টির দিক থেকে সবুজ ঘাস অতি উন্নতমানের।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রাব্বানী আমাদের সময়কে বলেন, গবাদিপশুর উৎপাদন খরচ কমাতে না পারলে মাংস ও দুধের দাম কমানো কষ্টসাধ্য হবে। উৎপাদন খরচ কমাতে সবুজ ঘাসের বিকল্প নেই। পশুখাদ্য হিসেবে সবুজ ঘাস নিশ্চিত করতে পারলে মাংস ও দুধের দাম কমানো সম্ভব।

এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগ রয়েছে। গবাদিপশু খাতের উন্নয়নে সরকার পাঁচ বছর মেয়াদে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সরকার এবং বিশ্বব্যাংক যৌথভাবে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে ২০১৯ সাল থেকে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর আওতায় গো-খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৪৬৫টি উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে উন্নত জাতের ঘাসের (নেপিয়ার, পাকচং, জাম্বু, পারা ইত্যাদি) নার্সারি বা প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। এসব নার্সারি থেকে উৎপাদিত কাটিং আগ্রহী কৃষক ও খামারিদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতাভুক্ত উপজেলার খামারিদের এ ধরনের ঘাস চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

বাণিজ্যিক ও প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চারণভূমির অভাবে বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গোয়ালে (শেড) রেখে গবাদিপশু পালন করা হয়। এক্ষেত্রে পশুকে খৈল, গমের ভুসি, ধানের ভুসি বা রাইস পলিশ বেশি খাওয়ানো হয়। এ ছাড়া মোটাতাজা করতে বিভিন্ন কোম্পানির কৃত্রিম ফিডও (দানাদার খাদ্য) দেওয়া হয়। এসব খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় গবাদিপশুর উৎপাদন ব্যয় অনেক গুণ বেড়ে যায়। এ ধরনের খাদ্যে উৎপাদনের বড় খরচ হচ্ছে (প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ)। অথচ বর্তমান বাজারে দানাদার খাদ্যের চেয়ে কাঁচা ঘাসের দাম অনেক কম। তাই উচ্চমূল্যের দানাদার খাবারের ওপর বেশি নির্ভরশীল না হয়ে উন্নত জাতের অধিক পুষ্টিসম্পন্ন ঘাস চাষের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা।

সাভার কৃত্রিম প্রজনন ল্যাবরেটরির সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার মো. শানে খোদা আমাদের সময়কে বলেন, খামারিদের ধারণা বেশি দানাদার খাবার দিলে গাভী ভালো দুধ দেবে। বাচ্চা ভালো থাকবে; কিন্তু এই ধারণা সঠিক নয়। এতে উল্টো গাভীর গ্যাসের সমস্যাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা বাড়তে পারে। সবুজ ঘাসে একদিকে খরচ কম, অন্যদিকে পুষ্টিকর।

সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার কোনাবাড়ির মামা-ভাগ্নে খামারির কর্ণধার সোহেল রানা আমাদের সময়কে বলেন, দিন দিন কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। এতে গবাদিপশুর চারণভূমি কমছে। ফলে খামারিরা বাধ্য হয়ে দানাদার খাবার দিয়ে পশুপালন করছেন। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশে দুধ ও মাংসের বাজারে অস্থিরতা কমবে না।

পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার কেনাই গ্রামের খামারি ওসমান গনি বলেন, সবুজ ঘাষ বেশি খাওয়ানোর চেষ্টা করি। তবে বছরের একটা সময়ে সবুজ ঘাস থাকে না। তখন দানাদার খাদ্য খাওয়াতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে মাংসের বাজারে।