ব্যয়বৃদ্ধির চাপে মানুষ

বাজেট এগিয়ে আসায় উদ্বেগ আরও বাড়ছে

রেজাউল রেজা
১৮ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
ব্যয়বৃদ্ধির চাপে মানুষ


একের পর এক সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। লাগাতার বাড়ছে ডলারের দাম। বাড়ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রভাব পড়ছে সার্বিক পণ্যমূল্যে। মূল্যস্ফীতির পারদ এখনো অসহনীয় পর্যায়েই রয়ে গেছে। এ সবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীই নয়, মধ্যবিত্তরাও জীবনযাত্রার যুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে এগিয়ে আসছে বাজেট। আগামী ৬ জুন নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অযৌক্তিকভাবেই বেড়ে যায় সবকিছুর দাম। এবারও এমনটাই ঘটবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। তাই বাজেট ঘোষণার দিন যত এগিয়ে আসছে, মানুষের উদ্বেগও ততই বাড়ছে।

আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্নমুখী। এতে করে ডলারের দামও দিন দিন বাড়ছে। আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। আইএমএফের বিপিএম৬ হিসাবে, দেশে রিজার্ভ রয়েছে ১৮ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এতে ডলারের মূল্যে অস্থিরতা বাড়ছে।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ হয়েছে, মার্চে যা ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। কিন্তু এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা বলছে, খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি; ১৫ শতাংশে উঠেছে।

বাজারচিত্রও বলছে, সবজি থেকে শুরু করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, মাংস সব পণ্যের দাম দরিদ্রদের নাগালের বাইরে রয়েছে। ভালো উৎপাদনের পরও চাল, পেঁয়াজ, আলু ইত্যাদি পণ্য কিনতে হচ্ছে অতিরিক্ত দামে। নতুন করে অবৈধ মজুদে ডিমের বাজারেও দাম লাফিয়ে বেড়েছে। একইভাবে বেড়েছে মুরগির দামও। কাঁচামরিচ, পেঁপেতে পর্যন্ত হাত ছোঁয়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে। বাজার ব্যয় সামলাতে নাভিশ্বাস দশা সাধারণ মানুষের। ডলারের মূল্য প্রায় সাড়ে ৭ টাকা বৃদ্ধিতে পণ্যের পাইকারি বাজারগুলোতে এরই মধ্যে দামবৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

বাংলাদেশের খাদ্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) চলতি মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের খাবার কেনার খরচ ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালে মাথাপিছু খরচ ছিল ১ হাজার ৮৫১ টাকা।

গত ফেব্রুয়ারিতে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯২৩ টাকায়।

শুধু খাদ্যপণ্য নয়, শিক্ষাসামগ্রীর দামও বেড়েছে। বেড়েছে যানবাহন ব্যয়। রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারেও খরচ আগের চেয়ে বাড়তি। চিকিৎসাসেবা ও ওষুধেও ব্যয় বেড়েছে হু-হু করে। তেল, সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট থেকে শুরু করে প্রতিটি ব্যবহার্য পণ্যের পেছনে খরচ বেড়েছে। বেড়েছে পোশাক ও বিনোদন খরচ। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পেরে না উঠে অনেকে মৌলিক চাহিদাতেও কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন।

বাজার খরচে হিমশিম খাচ্ছেন কদমতলী এলাকার বাসিন্দা নাসিমা আক্তার। কথা হলে তিনি বলেন, বাসাবাড়িতে কাজ করে যে সামান্য আয়, তা বাড়ি ভাড়া আর বাজার খরচ সামাল দিতেই ‘নাই’ হয়ে যায়। চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ মেটানো যায় না। বাধ্য হয়ে ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়েছে। তাদের কারখানায় কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। এরপরও এ শহরে টিকে থাকতে প্রতিমাসেই ঋণ করতে হচ্ছে।

জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছেন না বেসরকারি চাকরিজীবী মো. কৌশিক আহমেদ। রীতিমতো ঋণ করতে হচ্ছে তার। কথা হলে কৌশিক বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে যাতায়াত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রতিটি খাতে খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বেড়েছে। এমনকি ওষুধের দামটা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ বেতন বাড়ে না। সীমিত আয়ে সব খরচ সামাল দিয়ে চিকিৎসা কিংবা বিনোদনে কোনো খরচই করতে পারছি না। সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলি। এমনকি সাশ্রয়ী হতে মাছ-মাংস খাওয়া কমাতে বাধ্য হয়েছি। পোশাকে খরচ কমিয়েছি। এরপরও পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে ঋণ করতে হচ্ছে। ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে।

২০১৮ ও ২০২৩ সালের তুলনা করে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির যৌথ এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কিছুটা কমলেও একই সময়কালে শহরে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। শহুরে দারিদ্র্যবৃদ্ধির পেছনে দুটি কারণ উঠে এসেছে। প্রথমত, নাজুক দরিদ্রদের একটি বড় অংশ শহরাঞ্চলে বাস করে। যারা দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রভৃতি কারণে শহরে স্থানান্তরিত হয়েছিল। সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির মতো উল্লেখযোগ্য ধাক্কাগুলো এই নাজুক লোকদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, শহুরে এলাকায় বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে এ শ্রেণির মানুষজন ব্যাপকভাবে আওতাভুক্ত না হওয়া। যার ফলে অনেক শহুরে পরিবার ধাক্কা খাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলার সংকটের প্রভাব এখন দেশের পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে সরকারের লেনদেনে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, ঋণ পরিশোধের খরচ বেড়েছে, জ্বালানিতেও খরচ বাড়ছে। সেই সঙ্গে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। তাদের মতে, একদিকে ভুল অর্থনৈতিক-নীতি সংকটকে আরও প্রকট করছে। অপরদিকে সঠিক সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণ না করায়, দেরিতে উদ্যোগ নেওয়ায় জনসাধারণের উপর অতিরিক্ত চাপ ফেলছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে আগে থেকেই সংকট ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর যা তীব্র হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সংকটগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার জন্য এখন আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা যাবে না। কারণ, বিশ্ব অর্থনীতিতে এর যে সব প্রভাব পড়েছিল তা অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা গেছে। কিন্তু আমরাই পারিনি। উল্টো আমরা যে সব পদক্ষেপ নিয়েছি, তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক এ মুখ্য অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, একদিকে সঠিক সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণ করা হয়নি। অপরদিকে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলোরও বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গতি না থাকলে সেটা আরও বেশি সমস্যা তৈরি করে। মূল্যস্ফীতি কমাতে এতদিন যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা কাজে তো আসেইনি, বরং সংকট উসকে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এখন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো দেরিতে হওয়ায় জীবনযাত্রার উপর এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ছে। তদুপরি এখনো কথা-কাজে মিল থাকছে না। যেমন- সুদের হার বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।

অপরদিকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া মানেই মূল্যবৃদ্ধি- এটি ঠিক নয়, মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ভর্তুকি তুলে নিতে দাম বাড়িয়ে দেওয়া সহজ পন্থা। কিন্তু দাম না বাড়িয়েও ভর্তুকি তুলে নেওয়া যায়। যেমন- বিদ্যুতের ক্ষেত্রে উৎপাদনে যে যথেচ্ছ অপচয় রয়েছে, সেগুলো কমিয়ে আনলেই বিপুল অর্থ সাশ্রয় সম্ভব। সেদিকে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী এখন যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হচ্ছে এগুলো আরও অনেক আগে থেকেই নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে এতটা চাপ অনুভূত হতো না। কথায় আছে- সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই দিশাহারা অবস্থা। এখন দশ ফোঁড় নিতে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ভোক্তাদের ত্রাহি অবস্থা।

তিনি আরও বলেন, আমরাও জ্বালানি তেলে ভর্তুকি প্রত্যাহারের পক্ষে। কিন্তু দামটা যেন স্থিতিশীল থাকে সেটা দেখতে হবে। জ্বালানি খাতে ‘মূল্য স্থিতিশীলতা তহবিল’ গঠনে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে ক্যাব। বিশ্ববাজারে যখন দাম কম থাকবে, তখন লাভের অর্থ তহবিলে জমা হবে এবং দাম বাড়লে তহবিলের অর্থে সমন্বয় করা যাবে। এভাবে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত। কিন্তু সেটা না করে এখন ঘনঘন সমন্বয় করা হচ্ছে, যেটা আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

গোলাম রহমান আরও বলেন, আসছে বাজেটে সবার অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। যাতে জীবনযাত্রার উপর চাপ কমে। সবাই সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের কথা বলেন। কিন্তু আমি বলব, কেবল ভাতার উপর নজর না দিয়ে কর্মসংস্থানের অধিকতর সুযোগ তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে।