বুড়িগঙ্গার দূষণ সরেছে ধলেশ্বরীতে

আব্দুল্লাহ কাফি
১৪ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
বুড়িগঙ্গার দূষণ সরেছে ধলেশ্বরীতে

চারবার প্রকল্প সংশোধন ও ১২ দফা সময় বাড়িয়েও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি সাভারের হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরী। কঠিন বর্জ্যরে দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচানোর লক্ষ্যে নেওয়া ১৭৫ কোটি টাকার প্রকল্পটির খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৫ কোটি টাকায়। প্রকল্পের সময় শেষ হয়ে গেলেও শেষ হয়নি আধুনিক কেন্দ্রীয় কঠিন বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ। ফলে চামড়ার কঠিন বর্জ্য এখন ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। ইতোমধ্যে নদীটির জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী মরতে শুরু করেছে। পচা চামড়ার উটকো গন্ধে এখন স্থানীয়দের বসবাস করা দায় হয়ে পড়েছে।

পরিবেশসম্মত কার্যকর সিইটিপি না হওয়ায় ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি)’ সনদ পাচ্ছে না ট্যানারিগুলো। ফলে আন্তর্জাতিক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোকে আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। কমপ্লায়েন্সের অভাবে বাড়তি দামও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রপ্তানি পণ্যের বড় খাত চামড়াশিল্প ধুঁকছে।

জানা গেছে, ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক)। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। আরও দুই বছর পর ২০১৭ সালে ট্যানারিগুলো সাভারে সরিয়ে নেওয়া হয়।

ট্যানারি সরে যাওয়ার পরও এখনো রেড জোনে রয়েছে রাজধানীর হাজারীবাগ। ফলে জমির মালিকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কিংবা জমি বিক্রিও করতে পারছেন না। আবার জমিতে বিনিয়োগও করতে পারছেন না। ফলে তাদের ক্ষোভ বাড়ছে।

এদিকে ট্যানারি মালিকদের কাছে ব্যাংকগুলোর প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ক্রিসেন্ট গ্রুপের কাছেই পাওনা রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩ হাজার কোটি টাকা পুরো ট্যানারিশিল্পে বকেয়া রয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ।

অভিযোগ রয়েছে, চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের তদারককারীদের অবহেলা, অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড এবং খরচ বাড়ানোর প্রবণতার কারণে বারবার চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের ব্যয় এবং মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে এক হাজার ১৫ কোটি টাকা খরচের পর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় কঠিন বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ পুরোপুরি কাজ শেষ হয়নি।

সিইটিপির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে। তবে এর নকশাতে ত্রুটি ছিল। এ কারণে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে, কিছু যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কালও শেষ পর্যায়ে। আবার গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোর কার্যক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে ঠিকমতো বর্জ্য পরিশোধন করা যাচ্ছে না।

সিইটিপি নির্মাণ শেষের আগেই প্রকল্প ছেড়ে চলে যায় চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সিইটিপির সংশোধন ও মানোন্নয়নের কাজ পিপিপিতে করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপরই সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে ‘ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে আলাদা একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। সম্প্রতি এই কোম্পানিতে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

ওই নিয়োগ পেয়েছেন গোলাম শাহনেওয়াজ। তিনি আমাদের সময়কে জানান, ৬ মাস আগেও সিইটিপির কার্যক্ষমতা ২৫-৩০ শতাংশ থাকলেও বর্তমানে ৪০-৫০ শতাংশ কার্যক্ষমতা চলছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ১২টি টেন্ডার ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে। আরও ৪টি টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কোরবানির আগে টেন্ডারগুলো সম্পন্ন হলে কার্যক্ষমতা ৭০-৮০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কঠিন বর্জ্যগুলোর জন্য নির্দিষ্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট না থাকায় নদীর পাড়ঘেঁষে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য কুকুরে নদী ও নদীর আশপাশে ফেলছে। খোলা জায়গায় গচা দুর্গন্ধ চামড়ার অংশবিশেষ ফেলার কারণে চারপাশের মানুষ দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। এলাকাবাসী জানান, গচা-গলা চামড়ার উৎকট গন্ধে এলাকায় থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা আরও কত বছর সহ্য করতে হবে তা জানা নেই কারও। স্থানীয়দের কাছে এখন অভিশাপ হয়ে উঠেছে ট্যানারিপল্লী।

জানা গেছে, সলিড ওয়েস্ট ফেলার জন্য চারটি পুকুর খননের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। আর তরল ওয়েস্ট অর্থাৎ লিকুইড ট্রিটমেন্টে আন্তর্জাতিক মানের শোধন হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।

বর্তমানে সিইটিপির কার্যক্ষমতা কম থাকায় কোরবানি মৌসুমে পশুর চামড়ার বাড়তি চাপ নিতে পারে না ট্যানারিগুলো। তাই ট্যানারিপল্লীতে পর্যায়ক্রমে চামড়া গ্রহণ করা হবে বলে জানান বিসিক চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার ভৌমিক। তিনি গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে যে সিইটিপি আছে সেটা সংস্কার করে কাজ চালানো হবে। তবে ট্যানারিপল্লীর পাশেই নতুন করে আরেকটি সিইটিপি নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া আছে বলেও জানান তিনি। সিইটিপির দক্ষিণ পাশে ২০০ একর জমিতে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য শেড স্থাপনসহ প্রস্তাবিত প্রকল্পে ৫০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে বিসিক সূত্রে জানা গেছে।

ট্যানারিপল্লী প্রকল্পটিতে অর্থ ও সময়ের অপচয় হলেও আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, মূল উদ্দেশ্য ছিল কঠিন বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপন করা। যেখানে কঠিন বর্জ্য শোধন করে পরিবেশ বাঁচানো হবে এবং ট্যানারিগুলো কমপ্লায়েন্স হবে। কিন্তু সাভারেও একই অবস্থা। এখন সাভারের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি ধলেশ^রী নদী নষ্ট হচ্ছে। সিইটিপি প্রস্তুত না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে বিশ^বাজারে প্রতিযোগিতা হারাতে হচ্ছে।