অবহেলা ও সচেতনতার অভাবে বাড়ছে মৃত্যু

তাওহীদুল ইসলাম
০৬ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
অবহেলা ও সচেতনতার অভাবে বাড়ছে মৃত্যু

সড়কে মৃত্যুর মিছিল আবার দীর্ঘ হয়ে উঠছে; দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই হতাহতের খবর মিলছে। কেন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা? এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নানা কারণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গাড়ির ফিটনেস ত্রুটি, অতিরিক্ত গতি, ওভারটেক, রাস্তার নকশায় ত্রুটি, মহাসড়কে ধীরগতির গাড়ি ঢুকে পড়া, চালকের অদক্ষতা ও বিশ্রামের অভাব, সড়কের খানাখন্দ ইত্যাদি কারণে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটছে। এ থেকে স্পষ্টÑ এসব দুর্ঘটনার পেছনে একদিকে রয়েছে অবহেলা, আরেকদিকে রয়েছে চালক, যাত্রী, পরিবহন মালিক ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা এবং সচেতনতার অভাব। সুতরাং এসব প্রাণহানি দুর্ঘটনা নয়, বরং অবহেলা বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন এবং সচেতন হন, তা হলে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্ঘটনা বলে দায় এড়ানোর প্রবণতা চলছে। ‘ইচ্ছা করে কাউকে মারা হয় না’, ‘দুর্ঘটনায় কারও হাত নেই’- এমন প্রচলিত বক্তব্যে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে জবাবদিহিতার বিষয়টি। উন্নত বিশে^ দুর্ঘটনাকে ‘ক্রাশ’ বলা হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব গোটা পরিবারকে তছনছ করে দেয়। এ অবস্থায় সড়কে দুর্ঘটনাকে অবহেলা বলার পক্ষে মত জোরালো হচ্ছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, বিশ^ব্যাপী দুর্ঘটনা দৈবচয়ন, যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা মোটেও দৈবচয়ন নয়। তাই আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। যানবাহনের রুট পারমিট, ফিটনেস, চালকের উপযুক্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি অনেক ইস্যু রয়েছে। এ জন্য বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, সওজসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ আছে। সবার সমন্বিত কাজ দরকার। অবহেলা হলে তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা লাগবে। বাড়াতে হবে গাড়িতে প্রযুক্তির ব্যবহার। ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে ক্যামেরা যুক্ত করা যেতে পারে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অনিদ্রা। বর্তমানে পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্যগত বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। বিশ্রামাগার এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। টানা ৪ ঘণ্টার বেশি চালক স্টিয়ারিংয়ে থাকতে পারেন না। মেজাজ ধরে রাখা কঠিন। এ ছাড়া কর্মঘণ্টা ও উন্নত মজুরি সবই বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন না করে কেবল দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যানবাহনের ফিটনেস ত্রুটি, রুট পারমিট না থাকা, চালকের দোষ- এ রকম বহু কারণ আছে দুর্ঘটনার পেছনে। দূরপাল্লার উপযোগী নয়- এমন বাহন মহাসড়কে চলাও দুর্ঘটনার কারণ। আবার ধীরগতির যান মূল সড়কে উঠে পড়ছে হরহামেশা। ফিডার রোড বা সংযোগ সড়ক থেকে গাড়ি মহাসড়কে ওঠার কথা নয়। তা ছাড়া চালকের অনিদ্রা, বিশ্রামের অভাব ইত্যাদি অনেক কারণেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সব ক্ষেত্রেই চালকরা দায়ী নয়। গাড়ির ফিটনেস ঠিক রাখতে পরিবহন মালিকদের অবহেলা আছে। পথচারীরা হঠাৎ করে গাড়ির সামনে চলে গেলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এমন ক্ষেত্রেও চালকরা গণপিটুনির শিকার হন। অথচ দায়ী পথচারী। আবার নিয়ম ভেঙে ধীরগতির বাহন চলতে দেখা যায় মূল সড়কে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, অতিরিক্ত গতি কিংবা ওভারটেক চালকের দায় তা মানি। কিন্তু গাড়ির ফিটনেস না থাকায় মালিকের দোষ বেশি। চালকরা মালিককে গাড়ি মেরামতের কথা বললেও গড়িমসির অভিযোগ আছে। তাই দুর্ঘটনায় দায় নিশ্চিত করা দরকার। সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারলেই কেবল সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কোনো একক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মাধ্যমে কমানো সম্ভব নয়। সবার আগে সচেতন হতে হবে মানুষকে। যাত্রীদের ট্রাকে চড়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার এসব বাহন রাস্তায় চলতে দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয় বাধা দেবে। অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা, যাত্রী, পরিবহন মালিক সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। দুর্ঘটনায় তো চালকরাও মারা যান। তাই গাড়ির ফিটনেস থেকে শুরু করে সবকিছু আইন মেনে চললে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তাই সামাজিক সচেতনতা জরুরি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সারাদেশে ৭২ লাখ ৬০ হাজার ৭৭২টি ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে অপেশাদার ৫৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩৭৮টি এবং পেশাদার লাইসেন্স আছে ১৯ লাখ ২১ হাজার ৩৯৪টি। দেশে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে ৫৯ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৫টি। ৬ লাখ ১৮ হাজার ৪৮৮টি ফিটনেসের মেয়াদোত্তীর্ণ। অবৈধ নসিমন-করিমন, থ্রি হুইলার, ফিটনেসবিহীন মোটরযান ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল সড়ক-মহাসড়কে চলাচল, মোটরযানের অতিরিক্ত গতি এবং মালবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন ইত্যাদি নানা কারণে সম্প্রতি দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে বলে মনে করছে বিআরটিএ।