রিমান্ডে মিল্টন, মিলছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

নজরদারিতে স্ত্রীসহ আশ্রমের কর্মীরা

নিজস্ব ও আদালত প্রতিবেদক
০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
শেয়ার :
রিমান্ডে মিল্টন, মিলছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

বহুল আলোচিত-সমালোচিত সমাজকর্মী এবং ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নানা অপকর্মের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। মানবিক কর্মকা-ের জন্য তিন-তিনবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়া মিল্টনকে গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় তার কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে তোলা হলে বিচারক তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মিল্টনের বরাত দিয়ে ডিবি পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সিটি করপোরেশনের সনদ ছাড়াই রাতের আঁধারে মরদেহ দাফন করতেন মিল্টন। এমনকি লাশ দাফনের পর তিনি নিজেই চিকিৎসক, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সিল ও স্বাক্ষর জাল করে মৃত্যুসনদ দিতেন। সেসব সিলও জব্দ করেছে ডিবি পুলিশ। অসহায়দের আশ্রয়দানের নামে লাইসেন্স ছাড়াই চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের অপারেশন থিয়েটারে অবৈধভাবে রোগীর অপারেশন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রিসহ নানা অভিযোগও মিলেছে তার বিরুদ্ধে।

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে গতকাল পর্যন্ত মৃত্যুর জাল সনদ তৈরি, তার আশ্রমে টর্চার সেলে মানুষকে নির্যাতন ও মানবপাচারের অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে। মৃত্যুসনদ জাল করার অভিযোগে করা মামলার শুনানি শেষে গতকাল তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন। এর আগে, মিরপুর মডেল থানায় করা এ মামলায় মিল্টন সমাদ্দারের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) এসআই কামাল হোসেন। মিল্টনকে গ্রেপ্তারের পর থেকে তার স্ত্রী মিঠু হালদার ও আশ্রমের কয়েকজন কর্মীও নজরদারিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।

জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন জানান, তিনি কোনো নিবন্ধিত ডাক্তার নন এবং তার ওই প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত কোনো ডাক্তার নিয়োগ প্রদান করেননি। তিনি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে নিজে ডাক্তার সেজে এজাহারনামীয় পলাতক আসামির সঙ্গে যোগসাজশে প্রতারণামূলকভাবে বিভিন্ন চিকিৎসা করে, সেবা প্রদান করে, ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট তৈরি করে ফেসবুক হোয়াটসআপ ও ইমোর মাধ্যমে ১ কোটি ২০ লাখ ফ্রেন্ড-ফলোয়ারের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ উপার্জন করেন।

মিল্টন দীর্ঘদিন ধরে মানবতার সেবার নামে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষকে শারীরিক, মানসিক আঘাত করে কখনো কখনো তাদের সুচিকিৎসার নাম করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে বিক্রি করে থাকেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জালজালিয়াতির মাধ্যমে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে আসছিলেন।

গতকাল শুনানিকালে বিচারকের প্রশ্নে মিল্টন বলেন, আশ্রমটি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা করি। পরের বছর সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করি। আমাদের কার্যক্রম দেখে অধিদপ্তর ২০১৮ সালে নিবন্ধন দেয়। এখানে শুধু পরিচয়হীন ছিন্নমূল মানুষকে এনে আশ্রয় ও চিকিৎসা দিই। আশ্রম সাধারণ মানুষের অনুদানে পরিচালিত হয়। ২০১৭ সাল থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আয়-ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট সংরক্ষণ করি। বর্তমানে এখানে পরিচয়হীন ২৫৬ জন আশ্রিত মানুষ আছে। এ পর্যন্ত ১৩৫ জন আশ্রমে থাকা অবস্থায় মারা যান। তাদের সমাহিতকরণের জন্য আমরা নিজস্ব চিকিৎসক দ্বারা নিশ্চিত হয়ে মৃত্যুর কারণ সংবলিত প্রত্যয়নপত্র দিই। এটা শুধু দাফনের কাজে ব্যবহৃত হয়। এসব মানুষকে দাফনের দায়িত্ব নিতে আমরা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করি। এমনকি হাইকোর্টেও আমরা আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কেউ তাদের দায়িত্ব না নেওয়ায় নিজস্ব ভাবে তালিকা করে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করি।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, বরিশালের উজিরপুরের মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ রয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিল্টন বলেছেন- তার দুটি আশ্রম রয়েছে। সাভারের আশ্রমে ৫ থেকে ৭শ লোক রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ২০ থেকে ৩০ জনের বেশি লোক নেই। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে, কত সংখ্যক মানুষ তার কাছে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। কত সংখ্যক মানুষ মারা গেল। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে মানবপাচার, শিশু ও বৃদ্ধদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখব। এ ছাড়া তিনি যে অনুদানের টাকা পেতেন তা যথাযথভাবে খরচ করা হতো কিনা, তার শেল্টার হোমে শিশু ও বৃদ্ধ যারা আশ্রিত থাকতেন, তাদের অভিভাবকরা এলে তাদের যে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে সেগুলোও খতিয়ে দেখা হবে। তার আশ্রমে অবৈধ যে অপারেশন থিয়েটার রয়েছে এর মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন কিনা সেটাও তদন্ত করা হবে। একই সঙ্গে তিনি যে ৯০০ লাশ দাফন করার কথা প্রচার করেছিলেন এবং ডেথ সার্টিফিকেটে নিজেই সিল বানিয়ে চিকিৎসকের স্বাক্ষর দিতেন, এসব অভিযোগও আমরা বিস্তারিত তদন্ত করে দেখব। মিল্টনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনে তার স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অভিযোগের প্রমাণ মিললে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।