ব্যাংকঋণ নির্ভরতা বাড়ছে সরকারের
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত বছরের আগস্টের পর থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ পাচ্ছে না সরকার। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যাংকঋণ এবার বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়েছে। তবে তারল্য সংকটে এখান থেকেও চাহিদানুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না সরকার। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ উপায়ে নেওয়া ঋণের সীমাও অতিক্রম হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের ১০ মাস না যেতেই (১ জুলাই থেকে ২২ এপ্রিল) শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওভারড্রাফট বাবদ ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৮ হাজার কোটি নির্ধারণ থাকলেও নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পুরনো ঋণের ১৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকার মতো পরিশোধ করেছে সরকার। ফলে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
সাধারণত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণে বরাবর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে যত সম্ভব কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের ব্যয় অনুপাতে আয় কম। এ কারণে সম্প্রতি সময়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার গতি বেশ বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতেই এসব ঋণ নেওয়ার সিডিউল ক্যালেন্ডার ঠিক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২২ এপ্রিল শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেওয়া ব্যাংক ঋণের স্থিতি প্রথমবার ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, যা গত বছরের ৩০ জুন শেষে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ দুই মাসেই বেড়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণ ছিল মাত্র ৫ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অন্যদিকে এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুন শেষে ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কমেছে ১৯ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। আর এই ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করা হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। তবে গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার চাপ ছিল অস্বাভাবিক।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস ২২ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড ৭৭ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার, যার পুরোটাই টাকা ছাপিয়ে (ডিভলভমেন্ট ব্যবস্থায়) সরবরাহ করা হয়েছিল। যদিও এবার আগস্টের পর থেকে পুরোপুরি টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেওয়া বন্ধ রেখেছে সরকার। তবে ডিভলভমেন্ট ব্যবস্থার বাইরে আরও দুটি উপায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে পারে সরকার। এগুলো হলো-ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স এবং ওভার ড্রাফট।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত সরকারের দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসাব কোনো কারণে না মিললে ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স এবং ওভার ড্রাফটের মাধ্যমে তা মেটানো হয়। এ দুই উপায়ে ৮ হাজার কোটি করে ঋণ নিতে পারে সরকার। তবে সরকারের হিসাব উদ্বৃত্ত হলে আগের দেনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধ হয়ে যায়।
প্রতিবেদন বলছে, ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স বাবদ সর্বোচ্চ সীমা ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া আছে সরকারের। ফলে চলতি অর্থবছরে ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স বাবদ নতুন করে ঋণ বাড়েনি। তবে ওভার ড্রাফট বাবদ ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৮ হাজার কোটি টাকার স্থলে নেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। ফলে ২২ এপ্রিল শেষে ওভার ড্রাফট ঋণের স্থিতি বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত ২২ এপ্রিল শেষে সরকারের ব্যাংকঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩৫০ কোটি টাকা। গত বছরের ৩০ জুন শেষে যা ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এই হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস ২২ দিনে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নেওয়া নিট ঋণের স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় ছিল প্রায় ৬ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি সরবরাহ করে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা, যা নতুন টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর বাকিটা নেওয়া হয়েছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে।
আরও পড়ুন:
পাল্টে যেতে পারে আন্দোলনের ধরন