দুই রাষ্ট্রের সমাধানেই স্থায়ী শান্তি সম্ভব
আবুল মোমেন
ইসরায়েলের পিছনে যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রয়েছে, সে কথা সকলেই জানি। তা বলে তারা নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে গেলেও কীভাবে তাদের সামরিক সাহায্য দেওয়া যায় তা কোনো মানদ-েই অনুমোদন করা যায় না। কিন্তু আজ ছয় মাস ইসরায়েল প্রায় একতরফা অকাতরে মানুষ খুন করে চলেছে। এমন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আবারও দেশটিকে দূরপাল্লার অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে। নিরপেক্ষ হিসাবে এ পর্যন্ত সাড়ে ৩৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে গাজায়। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা পনেরো হাজার, নারী প্রায় আট হাজার, জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থার ১৪০ জনের মতো কর্মী রয়েছেন। গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন শতাধিক। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন এ রকমই। তা ছাড়া প্রায় আশি হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন, যার বড় অংশ শিশু ও নারী। গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, হাসপাতাল সরাসরি স্থল আক্রমণের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, গাজার ধ্বংসস্তূপ সরাতে চৌদ্দ বছর সময় লাগবে।
পৃথিবীতে এমন মুসলমান ও নাগরিকের সংখ্যাই বেশি, যারা হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলা সমর্থন করেন না। কিন্তু সেই আক্রমণের বদলা কতজন হত্যা করে ও কতটা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নিতে চায় ইসরায়েল, তা সভ্য দুনিয়ার জানতে হবে। এ সময়ে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা কোনো অবস্থাতেই কাম্য ছিল না। কিন্তু এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এটি আরও সামরিক অভিযান ও আরও অস্ত্র সংগ্রহের অজুহাত হিসেবে ভালোভাবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নিজ দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক চাপে থাকা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্যে এই উত্তেজনা ভালো সুযোগ হিসেবে এসেছে। তিনি তা সম্পূর্ণ কাজে লাগাচ্ছেন এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে আক্রমণ দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনাও আঁটছেন।
সকলেই জানেন, শেষ পর্যন্ত দুই রাষ্ট্রই হলো প্যালেস্টাইন সংকটের সুষ্ঠু সমাধান। এটি জাতিসংঘ যেমন সমর্থন করে, তেমনি ইসরায়েলও ভালোভাবে জানে, জানে তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা। এই সর্বজনবিদিত ও গৃহীত সমাধানের কাজ ত্বরান্বিত না করে কেন তারা ইসরায়েলকে একটি খুনি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা বোধগম্য নয়। কেউ যেন না ভাবে যে, যা বর্তমানে নির্বিচারে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব তা কখনো ইতিহাসের কাঠগড়ায় বিচারের সম্মুখীন হবে না। আজ থেকে এক দশক পরে হলেও এই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের দায় নিতে হবে ইসরায়েল এবং তার নাগরিকদের। নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের। তারাই যুদ্ধকে তথা হত্যাকা-কে দীর্ঘায়িত করাচ্ছে।
আরও পড়ুন:
২৫ জিম্মিকে মুক্তি দিল হামাস
কোনো জনগোষ্ঠী কীভাবে চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে, কোন ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের মনে প্রতিশোধস্পৃহা জাগ্রত হয়, তা বুঝতে বড় দেশের বড় রাজনীতিবিদদের নিশ্চয় ভুল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমরা অতীতেও দেখেছি, ন্যাটো ও পশ্চিমা বিশ্ব বসনিয়ায় গণহত্যা থামাতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়নি। তারা বিলম্ব করেছে, সময়ক্ষেপণ করেছে- যা মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতির অবনতিতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু বসনিয়ার দুঃখজনক সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও গণহত্যার দায় এর সাথে সংশ্লিষ্ট হোতারা এড়াতে পারেননি। কেবল ইতিহাস নয়, আন্তর্জাতিক আদালতেই শাস্তি তাদের পেতে হয়েছে। আমরা জানি, বর্তমানে গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রচারণার যুগে নেতানিয়াহু ও তার যুদ্ধবাজ জাতিবিদ্বেষী সঙ্গীরা না ইতিহাস না আন্তর্জাতিক আদালত কোনোটার হাত থেকেই রেহাই পাবে না। বাস্তবতা হলো, ইসরায়েলের এই বেপরোয়া নির্বিচার গণহত্যার পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো এতদিনে চিহ্নিত হয়ে গেছে। তারা কেউই অবশ্য নিজেদের অবস্থান আড়াল করতে চায়নি। খোলাখুলি ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে মদদ দিয়েই চলেছে। ৭ অক্টোবরের হামলার জন্যে ইসরায়েল অবশ্যই সহানুভূতি লাভ করবে, কিন্তু আগ্রাসন ও গণহত্যার জন্যেও কেন তারা অনুমোদন পাবে। ইসরায়েলি বাহিনী তো আত্মরক্ষার যুদ্ধ করছে না, তারা আগ্রাসন চালাচ্ছে- এ কথা মনে রাখতে হবে।
এটা ঠিক যে ইসরায়েলকে পাল্টা হামলা চালানোর অজুহাতটা তৈরি করে দিয়েছিল হামাস। তবে তলিয়ে বিচার করলে প্যালেস্টাইনিদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানোর জন্যে ইসরায়েল ও বসতিস্থাপনকারীদের উসকানিও তো কম ছিল না। যে কেউই জানেন, এক্ষেত্রে প্রথম ধাপ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা যুক্তরাজ্যের এবং পরবর্তীকালে সে রাষ্ট্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের। তাদের প্রশ্রয়ে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইসরায়েল নিজেদের একটা আগ্রাসী জাতি ও রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বলব, এবার লাগাম টানুন। ইসরায়েলকে আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধে বাধ্য করুন। দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে দুই রাষ্ট্রের ফর্মুলা অনুযায়ী সমাধানের পথ খ্ুঁজুন। তার মধ্যেই নিহিত আছে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি, তাতে অন্তত ইসরায়েলের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে জীবন অতিবাহিত করতে সক্ষম হবে। যে কোনো রাষ্ট্রের তো এটাই কাম্য- যুদ্ধ পরিস্থিতি, চিরায়ত বৈরিতা, দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত কারও কাম্য হতে পারে না। কেবল খুনি মনোবৃত্তির নেতা ও চরমপন্থিদের দমাতে হবে, পরাস্ত করতে হবে। যুদ্ধের উভয় দিকের জন্যেই এটা সত্য এবং এটাই হওয়া উচিত গন্তব্য। হামাসকে সন্ত্রাসী পথ পরিহার করতে হবে, আবার তার উপযোগী বাতাবরণও তৈরি করত হবে। দ্বিমুখী নীতি বা মানদ- নিয়ে চলার দিন শেষ। এতে কেবল ছোট বড় সংঘাত বৃদ্ধি পায়, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়ে এবং এর মূল্য দেয় সব পক্ষের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের জন্যে এবার কাজ করা দরকার- যুদ্ধবাজ নেতা বা সেনাপতিদের জন্যে নয়।