নারী আম্পায়ারিং কি চাননি মুশফিক-তামিমরা, কী ঘটেছিল সেদিন?
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে সুপার লিগের ম্যাচে গত বৃহস্পতিবার মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব। মৌসুমের হাইভোল্টেজ এই ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এ আই এম মনিরুজ্জামান ও সাথিরা জাকির জেসিকে। সেই ম্যাচে একটি বিতর্কিত ক্যাচের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রিকেটপাড়া থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন সরগরম।
ম্যাচ শেষে রব ওঠে নারী আম্পায়ার সাথিরা জাকির জেসিকে নিজেদের ম্যাচে চায়নি মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংক কেউই। এমনকী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে অভিযোগের তীর ক্রিকেটারদের দিকেও রাখেন, তারাও নাকি ম্যাচে নারী আম্পায়ার চাননি? যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি না জানালেও মৌখিকভাবে নিজেদের অনীহা প্রকাশ করার কথা স্বীকার করেছে দুটি ক্লাবই। তবে ক্রিকেটারদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সেদিন মূলত প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের আউট ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়। ক্লাবের রান তাড়ায় ৩৪তম ওভারের ঘটনা সেটি। অফ স্পিনার নাঈম হাসানকে স্লগ সুইপ খেলেন মুশফিক। স্কয়ার লেগ থেকে বাঁদিকে অনেকটা দৌড়ে ফুল লেংথ ডাইভ দিয়ে বল তালুবন্দি করেন আবু হায়দার। বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ হলেও ফিল্ডারের পা লাইন স্পর্শ করায় বিতর্কে ম্যাচ থেমে ছিলো ১৩ মিনিট।
প্রথমে মুশফিক আউট ভেবেই মাঠ ছাড়ছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে ইউটিউবে রিপ্লে দেখে বাইরে থেকে মুশফিককে থামতে বলেন সতীর্থদের কেউ। তিনি মাঠে দাঁড়িয়ে যান। প্রাইম ব্যাংকের ক্রিকেটাররা সীমানার পাশে জড়ো হন সবাই। ফোনে রিপ্লে দেখতে থাকেন অনেকে।
এক্ষেত্রে অবশ্য মাঠের আম্পায়ারের দিকে আঙুল তোলার সুযোগ ছিলো না, সেটা করেওনি প্রাইম ব্যাংক। টিভি রিপ্লে না থাকায় ফিল্ডারের সততার উপরই নির্ভর করতে হয় আম্পায়ারদের।
সেসময় মাঠে উপস্থিত থাকা ক্রিকেটারদের কয়েকজন জানিয়েছেন, আবু হায়দার তখন বলছিলেন যে, তিনি নিশ্চিত নন যে তার পা দড়িতে লেগেছে কি না। খেলা বন্ধ থাকার সময়টায় প্রাইম ব্যাংকের পক্ষ থেকে ভিডিও দেখানো হয় মোহামেডানের ম্যানেজমেন্টকে। কিন্তু তারা আবেদন তুলে নেননি। আম্পায়ারদের এরপর আর কিছু করার ছিল না।
দুই আম্পায়ার এআইএম মনিরুজ্জামান ও সাথিরা জাকির জেসি নিজেদের মধ্য আলোচনার পাশাপাশি দুই দলের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এক সময় আম্পায়ার মনিরুজ্জামান আঙুল উঁচিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েই মাঠ ছাড়তে হয় মুশফিককে।
তবে ম্যাচের পরদিন জানা যায়, দুই দলের নারী আম্পায়ার নিয়েই আপত্তি ছিল। বিসিবির আম্পায়ার কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ মিঠু একটি সংবাদমাধ্যমকে এ নিয়ে বলেন, 'হ্যাঁ, বিসিবি নারী আম্পায়ারকে দায়িত্ব দেওয়ায় তারা অখুশি ছিল। কিন্তু ম্যাচ চলেছে। তারা মন্তব্য করে নিজেদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তারা আমার কাছে কোন অভিযোগ করেনি, সিসিডিএমকে বলেছে। তবে এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও একজন নারী। আমাদের এই ধরনের নিয়োগকে উৎসাহ দেওয়া উচিত।'
মোহামেডানের ক্রিকেট সমন্বয় তরিকুল ইসলাম টিটু এই ব্যাপারে মৌখিকভাবে নিজেদের অখুশি মনোভাব প্রকাশ করেন, 'আমরা আসলে আপত্তি তুলিনি। আমরা এমনিতে বলাবলি করছিলাম যে ম্যাচের মেরিট অনুযায়ী তো এত বড় ম্যাচে জেসি আম্পায়ার হতে পারে না। আমরা বলছিলাম এত বড় ম্যাচে আরও ভালো আম্পায়ার দরকার ছিলো। আমরা অফিসিয়ালি অভিযোগ করিনি, অফিসিয়ালি অভিযোগ করব কেন। আমরা ওরকমভাবে রিপোর্ট টিপোর্ট করিনি।'
প্রাইম ব্যাংক ম্যানেজার শিকদার আবুল হাশেম কঙ্কনের কথায় ইঙ্গিত মেলে তাদের আপত্তি নারী আম্পায়ার হওয়াতেই ছিল, 'মহিলা আম্পায়ার দেবে এটা তো জানি না আমরা। বাংলাদেশে মহিলা আম্পায়ারের অভিজ্ঞতা কেমন এটা তো আমরা সবাই জানি। আপত্তি করি না। যেহেতু এটা বড় ম্যাচ, এখানে নিয়মিত যারা করে তাদের আশা করছিলাম। মহিলা আম্পায়ার দেখেন যেটা এলবিডব্লিউ সেটা দেয় নাই, যেটা হয় নাই সেটা দিছে। আমরা ম্যাচ শুরুর আগেও কিছু বলিনি। এমনিতে নিজেরা আলাপ করেছি। সিসিডিএমের কাউকে বলিনি। নিজেরাই আলাপ করেছি। অনভিজ্ঞতার জন্যই।'
সেই ঘটনার সময় আম্পায়ারদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল প্রাইম ব্যাংকে মুশফিকের সতীর্থ তামিম ইকবালকেও। তবে তিনিও আম্পায়ারদের দায় দেখছেন না, ‘আম্পায়ারদের এখানে আসলে কিছু করার নেই। তারা নিয়ম অনুযায়ীই কাজ করেছেন। আমরা হতাশ ও অবাক হয়েছে প্রতিপক্ষের কাজে। ফিল্ডার দাঁড়ানোর সময় পা লেগেছে দড়িতে, তার বোঝার কথা। তাছাড়া ভিডিওতেও পরিষ্কার যে দড়ি সরে গেছে। খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার যে, তারা (মোহামেডান) নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তেই অটল ছিল।’
এদিকে ম্যাচের পরের দিন শুক্রবার সকালে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ছবি পোস্ট করেন মুশফিক, যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ক্যাচ নেওয়া ফিল্ডারের পা স্পর্শ করেছে সীমানা দড়ি। সেই জায়গাটুকু লাল দাগে চিহ্নিত করে মুশফিক স্রেফ লিখেছেন, ‘মা শা আল্লাহ।’ পাশে তিনটি ইমোজিও ছিল, যেগুলোতে ফুটে ওঠে হতাশা বা বিরক্তি কিংবা বিষাদ। এই ম্যাচে খেলা আরেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটার রুবেল হোসেন এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করেন, ‘খুবই দুঃখজনক ভাই।’
ফর্মে থাকা মুশফিক সেদিন আউট হয়ে যান ১০ রান করে। ৩১৮ রান তাড়ায় প্রাইম ব্যাংক ম্যাচটি হেরে যায় ৩৩ রানে।